সবুজ দ্বীপ আন্দামান (বিংশ পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বিংশ পর্ব

          জারোয়ারা অর্ধ যাযাবর হলেও যখন এক কুটির থেকে অন্য কুটিরে যায় তখন কিন্তু কুটিরগুলি তারা ভেঙে দেয় না। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় অনেক কুটির আজ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র প্রধান কুটির গুলি যেগুলি আজও বিদ্যমান এবং জারোয়াদের দ্বারা ব্যবহৃত তাদের সংখ্যা উপরে দেওয়া হয়েছে। আদিম জনজাতি জারোয়ারা কুটিরের নামকরণ করে জায়গার বিশেষত্ব বা পূর্বপুরুষদের নাম দিয়ে। পূর্বপুরুষদের কথা স্মরণ করা, তাদের মর্যাদা ও শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যে তাদের উন্নত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। সম্প্রদায়গত কুটিরগুলি এক একজন জারোয়ার তত্ত্বাবধানে থাকে। যে কুটিরে জারোয়া শিশু তার মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় তা তার কাছে জন্মভূমি। সেই কুটির তার কাছে খুবই প্রিয় এবং স্বর্গের সমান। তাদের এই জন্মভূমিকে জারোয়ারা বলে 'ওলকথে'।

          জারোয়াদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা: জারোয়ারা খুব ভোরে উঠে কুটির ছেড়ে শিকারে যায়, শুধু অসুস্থ জারোয়ারাই কুটিরে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু মহিলা ও শিশু কুটিরে থাকে, বাকিরা বিভিন্ন কাজে বাইরে যায়। জারোয়ারা সারাদিন শিকার করে শিকারলব্ধ খাদ্য সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যাবেলা ফিরে আসে। সন্ধ্যাবেলায় কর্মব্যস্ত শিকারি জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে ওঠার জন্য নাচ-গানে মত্ত হয়। অল্প রাত্রি হলেই শিকার করা খাদ্য খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। শিকারে যাওয়ার সময় জারোয়ারা দলবদ্ধভাবে শিকারে যায় এবং তখন তারা কেকাড্ বা বর্ম পরে তীর-ধনুক হাতে জঙ্গলে যায়। জারোয়াদের শিকারি জীবনে পুরুষ ও নারী সবাই কাজ করে। যেদিন শিকারে যায় না সেদিন  পুরুষেরা কুটিরে তীর-ধনুক, ছুরি ও মধু রাখার পাত্র বানায়। জারোয়া যুবকেরা অন্যান্য কাজের ফাঁকে চেস্ট গার্ড বা বুকের বর্ম বানায়। এই বর্ম তাদের কাছে মূল্যবান ব্যক্তিগত সম্পদ। মহিলারা বেতের ঝুড়ি তৈরি করে, কেহবা জাল বুনে দিন কাটায়। শিকারে যাওয়ার জন্য এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে পায়ে হেঁটে যায়। সংঘবদ্ধভাবে তারা সাঁতার কেটে সমুদ্রের খাঁড়ি ও নালা পার হয়। সাঁতারের সময় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে গায়ে কাঁটা গাছের লতা পরে। তবুও সমুদ্রের নালা পার হওয়ার সময় অনেকেই কুমিরের হাতে প্রাণ বিসর্জন দেয়। আসল কথা প্রকৃতির প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেই তারা বেঁচে আছে। জারোয়ারা জঙ্গলে শিকারে গেলে জংলি শুকর তাদের প্রিয় খাদ্য। প্রায় দিনেই তারা জংলি শুকর পেয়ে যায়। কোন কোন দিন অবশ্য খালি হাতেও ফিরে আসতে হয়। জংলি শুকর ছাড়াও গোসাপ, পোকামাকড় ও মধু তাদের আহার্য দ্রব্য। এছাড়াও সমুদ্রের মাছ তীর-ধনুক বা এক রকমের হাতে তৈরী জাল দিয়ে ধরে। গাছের ফল আহরণ তাদের দৈনন্দিন জীবনের কর্মসূচির মধ্যে পড়ে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জঙ্গলের মধ্যে শিকার করা ছাড়াও তারা চাঁদনী রাতে লোকালয়ের বাগিচা থেকে কলা ও নারকেল চুরি করে আনে। অবশ্য আজকাল তারা দিনের বেলাতেই লোকালয়ের বাগিচা থেকে কলা ও নারকেল নিয়ে চলে আসে। শিকার থেকে ফিরে জারোয়াদের জীবন হয় অন্য ধরনের। সমস্ত ক্লান্তি ভুলে যায়। যে দিন ভালো শিকার পায় সেদিন তারা খুশিতে নাচ গান করে কুটিরের সামনে আগুন জ্বালিয়ে। কয়েক ঘণ্টা নাচ-গান করে। মহিলারা শিকার করা খাদ্য সামগ্রী রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়।  তারপরে তারা শিকার করা খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। জারোয়ারা শিকার লব্ধ খাদ্যকে কাঁচা পুড়িয়ে অথবা সিদ্ধ করে খায় একথা আগেই উল্লেখ করেছি। কাঁচা খাওয়া বা আগুনে ঝলসে খাওয়া বহু পুরাতন প্রথা। আগুনের ব্যবহার তারা আগে থেকেই জানে। পাথরে পাথর ঘষে বা কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালাতে তারা পটু। অবশ্য আজকাল তারা দেশলাই বাক্সের সাহায্যে আগুন জ্বালাতে শিখেছে। গ্রেটআন্দামানিজদের মত জারোয়াদের কাছেও একটা দেশলাই বাক্স সবচেয়ে বড় বিস্ময়কর ও মহামূল্যবান জিনিস। জারোয়ারা খাবারে লবণের ব্যবহার করেনা বা জানে না। কোনরকম তেল মশলাও তারা ব্যবহার করেনা। আজকাল তাদের খাদ্যাভ্যাসে একটু পরিবর্তন এসেছে, কারণ লোকালয়ে এসে তেল-মসলাযুক্ত খাবার খাচ্ছে। জারোয়া অঞ্চলে যে প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র কদমতলা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে সেখানেও জারোয়াদের জন্য আলাদা রান্নাঘর আছে যেখানে কোনো রকম তেল-মসলা ব্যবহার না করে তাদের সেদ্ধ খাবার দেওয়া হয়।

          রাত্রিবেলা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় ধূপ ও গালার বাতি তারা ব্যবহার করে। একটি কাঁচা সরু কাঠের দন্ডের মাথায় ছোট গর্ত করে ধূপ ও গালা জমা করে আগুন জ্বালায় এবং তা অনেকক্ষন দীর্ঘস্থায়ী থাকে। এছাড়াও জঙ্গলে প্রাপ্ত লম্বাটে ধরণের কাঁচা পাতাকে (লম্বাপাতি, ধানিপাতি ও জংলি পাতা) বেশি সংখ্যায় একত্রে শক্ত করে বেঁধে সরু দন্ডের মাথার এক প্রান্তে ছোট গর্ত করে ধূপ ও গালা জমা করে তাতে আগুন দিয়ে দেয়। এইভাবে তারা অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে পথ চলে। অবশ্য আজকাল তারা লোকালয় থেকে মোমবাতি ও টর্চলাইট এনে তার ব্যবহার করতে শিখেছে।

          চেস্ট গার্ড পরে তীর-ধনুক হাতে গভীর অরণ্যে শুকর শিকার জারোয়াদের এক দক্ষতার নিদর্শন। যতক্ষণ পর্যন্ত না এক জারোয়া তরুণ একক চেষ্টায় তীর বিদ্ধ করে জঙ্গল থেকে শুকর শিকার করে না আনতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত জারোয়া সমাজ তাকে সাবালক হিসেবে ঘোষণা করে না। জারোয়ারা শুক্র শিকারে তীরের নিশানা নির্ভুল রাখে। একটি বা দুটি তীরই যথেষ্ট একটি বড় শুকরকে ধরাশায়ী করার জন্য। দশ-বারো বৎসরের জারোয়া শিশুও শুকর শিকারে পারদর্শী। অবশ্য খুব কম সময়ই তারা শুকর শিকারের সময় লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়। অল্প গভীর জলে তীরবিদ্ধ করে তারা মাছ শিকার করে এবং একইভাবে কচ্ছপও শিকার করে। মহিলারাও হাত জাল দিয়ে অথবা তীর-ধনুক দিয়ে মাছ ধরে। যদিও তীর-ধনুক দিয়ে মাছ শিকার করা মূলত পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জারোয়াদের দৈনন্দিন জীবনে তীর ধনুক হাতে গভীর অরণ্যে শিকার করা এবং অতীতের বহিঃশত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের সময় তারা তীরে বিষ মাখিয়ে রাখে বলে একটি প্রবাদ আছে, কিন্তু সে কথা সত্য নয়। আসলে জারোয়াদের অব্যর্থ নিশানায় তীরবিদ্ধ হয়ে অতীতে লোকালয়ের খুব কম মানুষই রক্ষা পেয়েছিল। অধিকাংশই মারা যেত। লোকালয়ের মানুষজন তাই ভাবতো জারোয়াদের তীরে বিষ মাখানো আছে এবং আদি মানবের থুতুতেও বিষ আছে। আদিম জনজাতি জারোয়ারা তীর ধনুকে খুবই পারদর্শী এবং সেটাই স্বাভাবিক। খুব ছোটবেলা থেকে তারা তীর-ধনুক চালানোর অনুশীলন করে যা খেলাধুলার পর্যায়ে পড়ে। বিভিন্ন সময়ে জারোয়ারা জঙ্গলে মধু পাড়ার সময় গাছ থেকে পড়ে অথবা মাছ ধরার সময় কুমিরের আক্রমণে মারা যায়। কখনো কখনো শিকার করার সময় অসুস্থ হয়েও মারা যায়। তাদের খাদ্যাভাস বলতে গিয়ে কিছু রন্ধনপ্রণালী বলা খুবই জরুরী। শুকরকে তারা তিন ভাবে রান্না করে। ছোট ধরনের শুকর মাংস যা খুবই নরম সেগুলি আগুনে ঝলসিয়ে খায়। মাঝারি ধরনের শুকর মাংস সিদ্ধ করে খায় এবং বড় ধরনের শুকর মাংস এক বিশেষ বেকিং পদ্ধতিতে রান্না করে।

ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !