কবিতা
তোমায় হারিয়ে
রী ণা পা ল দ ত্ত
আজ বৃষ্টি ভেজা হেমন্তের সকালটা
মনে করালো সেই পুরানো,
হারিয়ে ফেরা টলমলে প্রেমকে।
যেমন করে ভীত-সন্ত্রস্ত
মুক্তাভো জলকনা পদ্মপাতায়
নড়ে নড়ে ওঠে চমকে।
ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দু
মনে করিয়ে দেয় সেই চঞ্চলতা,
যখন হঠাৎ করে এসে সামনে;-
বলেছিলে, 'পাবে কি আমাদের
অন্তরের ভালোবাসা সফলতা'।
আমি বোবা বুকে-অবাক চোখে
তোমার দিকে চেয়ে ছিলাম,
পেয়েও হারানোর ভয়ে ভীত মন।
উজানে পাড়ি দেবার আগেই;
তাকে শক্ত হাতে বেঁধেছিলাম।
চোখে চোখ, অধরা কম্পিত ঠোঁট,
বুঝিয়ে দিয়েছিলো প্রথম প্রেমের
সদ্য ফোঁটা কুসুম কলিকে।
তুমি তৃপ্ত, তুমি দীপ্ত কন্ঠে
সমগ্র আকাশ-বাতাস ধ্বনিত করেছিলে মুখরিত করেছিলে।
চোরা বালির মতো শুষে যাচ্ছিলাম,
অব্যক্ত কামনায় লজ্জায়!
রাঙা চোখে, রাঙা ঠোঁটে ভালোবাসার
কি অপরূপ প্রশান্তির নীড়ে।
সব অধিকারটুকু দিয়ে ভরে দিয়েছিলে মন,
অস্থির অলিন্দের কাঁপন থামিয়ে।
যেথায় আজও পরম শান্তির স্পর্শ;
খুঁজে ফেরে জীবন 'তোমায় হারিয়ে'।
এখনও বন্ধ চোখের পাতায়
উঁকি দেয় সেই নেশা ধরা কামনা;
খুঁজে ফেরে স্মৃতির অমলিন পটে
হলুদ-পাখির নিত্য আনাগোনা।
চার-প্রকোষ্ঠ ব্যাপী, আবিলতায় মাখা
রূপ-অরূপের বিস্মৃত প্রেম-সুধা।
আমি নিঃস্ব, আমি রিক্ত, 'প্রিয়'!
তুলে রেখেছি একমুষ্ঠি 'প্রেমঝরা পাতা'।
জীবনের অধ্যায়
অ তু ল সে ন
সাদা কালো মেঘগুলো;-
ভেসে বেড়ায় আকাশের কোলে,
বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট
যায়না কখনোই বিফলে।
আজ কাছে নেই,
তারা আছে স্মৃতিতে;
যাদের সাথে কাটে ছোটবেলা,
তারা আছে অতীতে...
বন্ধু গুলো হারায় না
হারিয়ে যায় রাস্তা,
জীবনটাই পরিবর্তনশীল..
কেউ নয় সস্তা।
আরো হবে নতুন বন্ধু
ঠিক হয়তো তোদের মত নয়!
কলেজ জীবন শেষ হলো;
তার সাথে শেষ হলো জীবনের অন্যতম অধ্যায়।
মধুর শৈশব
নী তা ক বি মু খা র্জী
মানুষের জীবনে কত বেলা থাকে, বেলা এবং অবেলা,
কৈশোর-বেলা, বৃদ্ধ-বেলা এবং থাকে ছোটবেলা।
ছেলেদের যদি ছেলেবেলা থাকে, মেয়েদেরও থাকে মেয়েবেলা,
এই বেলাটাই সবচেয়ে প্রিয়, স্নেহ ভালোবাসা দেয় দোলা।
ছোট্ট মেয়েটি উঠোনের ধারে কত কি যে নিয়ে খেলা করে,
মায়ের আদর, বাবার স্নেহ শিশিরের মতো ঝরে পড়ে।
তারপরে খুকু ইস্কুলে যায়, দেখে সে নতুন পাঠশালা,
সখীদের সাথে খুনসুটি আর উচ্ছ্বলতায় প্রাণখোলা।
কতো দুষ্টুমি, ঝগড়াঝাটি, ভাব-আর আড়ি, কাড়াকাড়ি,
একটুখানি ব্যাপার নিয়ে কতো হাঁউমাঁউ ,বাড়াবাড়ি।
নষ্ট-চন্দ্রে সারারাত জেগে সবজি চুরির কতো মজা,
ছেলে-মেয়ে সব বন্ধু হয়ে দুষ্টুমি করার পথ খোঁজা।
ভাদু-জাগরণে কতো হাসি-গান, থালার প্রসাদ চুরি করা,
সকলের ভাগে ভাগ বসাতাম, ভয় হতো যদি পড়ি ধরা।
মায়ের শাসন, বাবার ধমক ছিলো যেন রোজকার পাওয়া,
কান্নাকাটি, বায়না ধরে রথের দড়িতে টান দেওয়া।
কোনো বাধাতেই ক্ষান্ত হবো না, জেদ করে সবকিছু করা,
কবে বড়ো হবো? সব হাতে পাবো, এই ভেবে হতো মাথাধরা।
মেয়েবেলাকার পুতুল খেলা, বৌ বৌ সাজ মন কাড়ে,
বড় হয়ে তারও সংসার হবে সুপ্ত বাসনা মনে বাড়ে।
চু-কিৎ-কিৎ, কানামাছি আর গাঁয়ের পুকুরে স্নান করা,
নাচ-গান শেখা, সরস্বতী পূজো, আরও কত কি যে প্রাণভরা।
সেই নিশ্চুপ শান্ত দুপুরে আঁচার চুরির ছক কষা,
লাল ফিতে দিয়ে চুল বাঁধা আর পড়ার টেবিলে চক ঘষা।
ছোট্ট-বেলার সেই সুখ-স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে, চোখে ভাসে,
বড়-বেলাতেও মন শুধু চায় ছোটবেলা যদি ফিরে আসে।
দোল-উৎসব, গাজনের মেলা, কতরকমের সুখস্মৃতি,
স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে খুঁজি ছোট্ট-বেলার সেই রীতি।
যত দিন যায়, হারায়ে খুঁজি ছোট-বয়সের ফাজলামি,
আর কি কখনো পাবো সে জীবন যতই খুঁজি এই আমি?
আগামীর শৈত্যে
বি শ্বে শ্ব র ম হা পা ত্র
বোকাবাক্সের সাপ্তাহিকে ঝোলানো
হাজার পর্বের পর্ণমোচী স্মৃতির ভীড়ে,
হারিয়ে চলেছে শৈশব কৈশোর যৌবন
সে সময় কভু আসবে কি আর ফিরে?
কামনার আগুনে ঝলসানো গল্পের কাবাবে
মজে আছি আমরা আজও একই ভাবে,
তারপর একরাশ হতাশায় কখন কার মন
হারিয়ে যায় যুক্তিহীন আত্মহননে প্রভাবে৷
কে রাখে কার খবর কতটুকু কবর খুঁড়ে
তবু প্রতিদিন মায়াজাল বুনে হিংসার দৈত্যে,
রেখে যায় একরাশ পর্ণমোচী স্মৃতিদের
আপন জঠরে আজ হতে আগামীর শৈত্যে৷
স্মৃতিতে সুখযাপন
সু মি তা চৌ ধু রী
কতোই না স্মৃতির বাস মনের চৌহুদ্দিতে,
টুকরো টুকরো জড়ো করে হয় কোলাজ।
এক একটা সময়ের গল্প বলে তারা,
ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই সময়ের স্রোতে।
আঙুল দিয়ে ছুঁতে চাই আদরে,
যেন যত্নে বোনা পশমেরই মতো।
নরম মোলায়েম সুখযাপনগুলো,
বুকের ওমে রেখে যতন করে।
কখন দমকা হাওয়া ঝড়ের দাপটে,
ফেরায় রুক্ষ-শুষ্ক বর্তমানের প্রেক্ষাপটে।
সুখ মরীচিকা হয়ে অট্টহাসে,
বিদ্রূপ করে সুখযাপনটাকে।
তখনই আঁকড়ে ধরি সর্বস্ব দিয়ে,
অতীতদিনের সুখ স্মৃতিগুলো,
সব হারিয়েও স্মৃতিতেই যে পাই;-
সুখযাপনের বাসরঘরটাকে।
গল্প
বিদায়
জ য় শ্রী স মা দ্দা র
শীতের দুপুরে রৌদ্রের তাপ কমে এসেছে। সুবীর বাবু দুলন্ত চেয়ারখানি হতে একাকী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন জানালার গরাদের ফাঁক হতে আকাশের পানে। সেথায় এক চিলতে অবিচ্ছিন্ন নীলিমার বুকে মাঝে মাঝে খেচরের আনাগোনা। এমনতর অবস্থায় চাকর মধুর আওয়াজ শোনা গেল, “ দাদাবাবু, তাপ কমে এসেছে, জানালাটা বন্ধ করে দিই! “ তিনি ক্লান্ত স্বরে বলে উঠলেন, “ আজ বড় ডানা মেলার স্বাদ হয়েছে রে মধু , তুই বরং খানিক পরে আয়।“ মধুর ভয় হয়, দাদাবাবুর শরীর ভালো আছে তো! গতবছর মা গত হতেই দাদাবাবু যেন একপ্রকার ভেঙে পড়েছেন। তার সন্তানেরা এখন দূরান্তে কর্মরত ,তাদের সময়ের বড় অভাব এই বয়স্ক মানুষটার প্রতি। দাদাবাবু একাকী মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে বিচরণ করেন। মধু বলে ওঠে, “ দাদাবাবু, আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে? জানালাটা টেনে দিই এবার! একটু পরেই ঠান্ডা পড়বে তো!” শোনা গেল, “ খোলা থাক। আজ নীলু আসবে।“ মধু জানালা বন্ধ করতে সাহস পায় না, ফিরে যায়।
সুবীর বাবুর দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে, শেষবারের ভ্রমণের স্মৃতি। পুরির সমুদ্রসৈকতে স্ত্রী নীলিমার সান্নিধ্যে এগিয়ে চলেছেন তটরেখা বরাবর, সূর্যোদয়ের রঙীন আভাস রেখে গিয়েছে বালুভূমি। চলতি পথের উপর এঁকে চলে তাদের জোড়া পায়ের নিদর্শন, সুবীর বাবুর হাত নীলিমা দেবীর হাতে আবদ্ধ।
কিছু সময়ের ব্যবধানে মধু জানালা বন্ধ করে দিতে আসে। সুবীর বাবুর গাত্রে চাদরখানি চাপা দিতে গিয়ে খেয়াল হয়, সে দৃষ্টি মুদিত হয়েছে বহু পূর্বেই...। ডান হাত হতে এক বিবর্ণ ছবি খসে পড়ে ভূমিতে। পুরির সৈকতের যুগলবন্দী যেন মলিন হাসিতে বিদায় জানায়।
ব্যার্থ প্রেমিক
আ বী র দা স
- না সে হারিয়ে যায়নি, না সে মনে রাখেনি কিছু!
সে আসলে ইচ্ছে করে মাঝপথে ছেড়ে গেছিলো। আমাকে খুব একা করে দিয়েছিল, কখনো ভাবিনি যে হ্যাঁ এটাও হতে পারে। যখন পড়াশোনা শেষ প্রায়, সরকারী চাকরীর পরীক্ষা গুলো দিচ্ছি ও খুব আশা দিত আমাকে যে তুমি প্রতিষ্ঠিত হবে, আমাকে কনফিডেন্ট দেখতে খুব ভালোবাসত। সে নিজের থেকেও বেশি আমাকে বোঝার চেষ্টা করতো। সে আমার সাথে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল নতুন একটা জীবনের। দুজনে একসাথে গলা ছেড়ে গান করতে পারবো, পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে যার কাঁধে মাথা রাখতে পারবো, সমুদ্র বেড়াতে গেলে হাতেহাত রেখে দুটো কথা বলতে পারবো। হ্যাঁ আমার খারাপ ভালো যখন সে বুঝত কিন্তু দিনশেষে সে কি সত্যিই আমাকে বুঝত, আমাকে ভালোবাসত! মনে হয় না, কারণ সে আমাকে দেখানো তার সেই নিখুঁত অভিনয় ভুল করতে চায়নি। সে এসেছিল আমার জীবনে প্রায় বারো বছর আগে। স্কুল লাইফ থেকে বন্ধুত্ব সেখান থেকে কখন যে সেটা ভালোবাসায় রূপ বদলালো বুঝতে পারিনি। জীবনে মোর ঘুরেছিল একটা। যে আমি হাসতে জানতাম না সে তার কাছে এসে হাসতে শিখেছে, ভালো থাকতে শিখেছে। এক আকাশ ভালোবাসতে শিখেছে প্রিয় মানুষটাকে। সদ্য জন্মানো প্রজাপতির মত অগুন্তি রঙ্গিন ফুলের বাগানে ডানা মেলে উড়তে শিখেছে।
মানুষের এই জীবনের মধ্যে হয়তো মোর ঘোরা দরকার তবেই আসল আর নকলের ফারাক বোঝা যায়। মানুষ বুঝতে শেখে, সে উপলব্ধি করত পারে তার চেতনাকে। আসলে ভালোবাসা, ভালোলাগা আর ভালোথাকা প্রত্যেকটা শব্দের মাঝে বিস্তর পার্থক্য। আর সেটাই আমরা মানুষেরা থুড়ি আমার মত ভালবাসায় অন্ধ বিশ্বাসী ছেলেরা সেটা বুঝতে পারে না। যে ছেলেটা প্রিয় মানুষটাকে ভালোবাসার কোনো কারণ চায় না অকারনেই তার জন্য পাগল সে আর যাই হোক গিরগিটির মতো রংবদলানো স্বার্থপর নয়। অনেক দূর ভেবে ফেলেছিলাম আমি তাকে নিয়ে, অনেক স্বপ্ন বুনেছিলাম মনের ভিতরে। অনেকটা ভালোবেসেছিলাম তাকে। কিন্তু সে হয়তো থাকতে চায়নি কিংবা আমার ব্যার্থতা আমি তাকে নিজের করে রাখতে পারিনি। হ্যাঁ আমি সেই ব্যার্থ প্রেমিক, সেই ব্যার্থ মানুষ যে অন্ধের মত ভালোবেসেছিলাম, ভালোবাসায় বিশ্বাস করতাম।
চাকরীর পরীক্ষায় পাশ করেও যখন একটু সময় লাগছে চাকরী পাওয়ার জন্য তখন সে আমাকে সেই সময়টা দিতে চায়নি। আমি শুধু সময় ভিক্ষা করেছিলাম তার কাছে কিন্তু সে দিতে পারেনি আমায়। সে আমার মধ্যে হয়তো সম্ভাবনা দেখেনি, সে হয়তো বেটার অপশন পেয়েছিল আমার থেকে। কিন্তু আর যাই হোক আমি তাকে রাখতে পারিনি, পারলাম না তাকে এত ভালোবেসেও আমার কাছে রাখতে। সময়টা হয়তো সত্যিই আমার খুব কম ছিল। কালবৈশাখি ঝড়ের মতো আমি লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিলাম তার না থাকায়। নিজেকে সবচেয়ে বেশি ব্যার্থ প্রেমিক মনে হয়েছিল সেদিন। হাত জোড় করেও তার কাছে যেতে পারিনি আমি। সত্যিই আমি একজন ব্যার্থ প্রেমিক। এত কিছুর মাঝে আমি নিজেকে গড়তে শিখেছি, নিজের জেদ হয়তো আবার ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।
হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে জানলার ধারের সিট-টায় বসে তখন হাজারও শব্দ ভিড় করছে অভ্রদ্বীপের মাথায় কিন্তু তা আর সঠিক ভাবে বাক্যে প্রতিফলিত হতে পারছে না। বারো বছর আগে যখন সে নিজেকে ভাঙতে দেখেছিল, একটা কাঁচ যেমন করে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ঠিক তেমন মনে হচ্ছিল তার। শিলিগুড়ি জংশন থেকে জলপাইগুড়ি হয়ে কলকাতা ফেরার ট্রেনে সেই মেয়েটা, রাইমার সাথে অভ্রদ্বীপের দেখা। যখন নিজের বুক করা সিট নম্বর চেক করতে ব্যস্ত তখন হটাৎ মুখোমুখি দুজন। সে আর তার হাসবেন্ড ঘুরতে এসেছিল। সে ভালোই আছে, খুব ভালো। গানের লাইন গুলোর সঙ্গে সেই মুহূর্তটা অনুভব করতে পারল অভ্রদ্বীপ। আসলে মানুষের জীবনে কতো ঘটনা, কতো মানুষ আর কতই না স্মৃতি। তার ভিড়ে কিছু স্মৃতি কুয়াশার মত মিলিয়ে যায় আর কিছু পর্ণমোচী গাছের পাতার মতো ঝরে যায়।
নিজেকে এখন আর ব্যার্থ প্রেমিক ভাবে না সেই ছেলেটা কিন্তু বাস্তবে সে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত একজন বিডিও। সবকিছুর মাঝে সে এখনও ব্যার্থ তার ভালোবাসার জন্য, তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে হয়তো তবে। জ্বলন্ত সিগারেটের ছাইয়ের সাথে ব্যার্থ প্রেমিকের সেই স্মৃতি গুলোও পর্ণমোচী পাতার মতো ঝরে পড়লো। ব্যার্থ প্রেমিকের সেই স্মৃতির সম্ভার আজ ঝরে পড়লো, সে নিজেকে হাল্কা করলো। সময় মতো প্রতিটা জিনিসই পর্ণমোচী পাতার মতো ঝরে যায়।
Please do not enter any spam link in the comment box.