সম্পর্ক

সম্পর্ক


- " কিরে এতক্ষণ লাগে ফোনটা ধরতে ? সেই কখন থেকে ফোন করছি । "
- " ঘুমাসনি এখনাে ? কাল সকালে অফিস আছে তো তাের ! "
- " তাের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল । ৮ বার কল করার পর তুই এখন ধরছিস ! কোথায় ছিলিস তুই ? বাড়িতে তাে মনে হয় রাত ১১ টার মধ্যে ঢুকে গেছিস ! এখন প্রায় দুটো বাজে । "
- " এগারােটা বাজতে দশে বাড়ি ঢুকেছি । শরীর ভালাে ছিল না তাই ফোন রিসিভ করতে পারিনি।তুই বল কি করছিস ? তুই কখন ঘুমাবি ? "
- " কি হয়েছে তাের ? শরীর ভালাে নেই না মন ? "
- " ভালাে লাগছে না রে কিছু ৷ " প্রচন্ড আফসােসের গলায় অস্মিতা বলে ।
শান্ত গলায় সুমন বলে " বুঝেছি ।"
- " কি বুঝেছিস ? "
- " মা - বাবার ঝগড়ার কথা বলছিস । তাই তাে ? " 
" হুম " বলেই চুপ করে যায় অস্মিতা ।
- " ওই , শােন না অস্মিতা , ছাড় না এসব কথা । ভুলে যা । মাথায় রাখিস না । তাের মন খারাপ থাকলে আমার নিজের ভালাে লাগেনা । "
সুমন বলে চলে- " ওই , তাের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়না । সেই দুসপ্তাহ আগে দেখেছিলাম তােকে । "
- " আমি এখন ভিডিও কল করতে পারব না । ঘরের লাইট বন্ধ । "
- " যা বাবা ! আমি কখন বললাম তােকে ভিডিও কল করতে ? "
- " তুইই তাে বললি , অনেকদিন দেখা হয় না । "
- " তাে ! দেখা করার জন্য ভিডিও কল ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই নাকি ? "
অবাক হয়ে অস্মিতা জিজ্ঞাসা করে - " মানে !!! "
- " মানে আবার কি । ভাবছি তাের বাড়ির সামনে আসবাে । "
- " রাত দুটো বেজে গেছে সুমন । এখন ইয়ার্কি করিস না । ভালাে লাগছে না । "
- " আরে , ইয়ার্কি কেন করব।সত্যি বললাম । "
এই বলেই সুমন বাইকের চাবির ছবিটা পাঠায় ওকে ।
- " রাত দুটো বাজে সুমন । কাল সকালে তাের অফিস আছে । কখন ঘুমাবি তুই ? আমার অফিস না হয় দুপুরে । আমার না ঘুমালেও চলবে । কিন্তু তাের তাে ঘুমাতে হবে । "
- " আমি তাের বাড়ির সামনে আসছি । ব্যালকনির সামনে দাঁড়াস । তােকে দেখবাে দুচোখ ভরে । প্রায় ১৫ দিন আগে দেখেছিলাম তােকে , সামনাসামনি । "
- " উফ্ফ কেন জ্বালাচ্ছিস ? আমি নাইট ড্রেস পড়ে আছি , ব্যালকনিতে আসবাে না । "
- " আচ্ছা ঠিক আছে , তাহলে আমি ঘরে চলে আসবাে । তাের বেডরুমে । আরেকটা কথা , রাত দুটোর সময় তােকে দেখতে , তাের ব্যালকনি দিকে কেউ তাকিয়ে থাকবে । "
- " পাগল নাকি ! আমি দরজা খুলবাে না । তুই এসে দাঁড়িয়ে থাকিস । "
- " তাের জান , তাের সামনে আসবে , তুই একবারের জন্য দেখাও করবি না ... অস্মিতা ? "
অস্মিতা ফোনের ওপারে শুনতে পেল সুমন বাইক স্টার্ট করল , " ওই , তুই সত্যিই আসছিস ? "
- " পাক্কা সাত মিনিট । সাত মিনিট অপেক্ষা কর আমি এক্ষুনি আসছি । " এই বলে ফোন কাটে সুমন , অস্মিতার কিছু বলার আগেই ।
অস্মিতা মনে মনে একটু হলেও খুশি হয় । কাজের চাপ , বাড়িতে অশান্তি সবমিলিয়ে ওর মন মেজাজ একদম ভালাে নেই কয়েক দিন ধরে । এর মাঝে সুমনের সঙ্গেও অনেকদিন দেখা হয়নি ওর , ভালােভাবে কথাও হয়নি । হয়তাে সুমনকে চোখের দেখা দেখে শান্তি পাবে না ও । কিন্তু ওর মাথায় একটা কথা কিছুতেই ঢুকলাে না , এত রাতে সুমন ওর সঙ্গে দেখা করতে আসছে কেন ? সুমন কি কিছু নিয়ে আসছে ওর জন্য ? এর আগে কখনাে সুমন এত রাতে আসেনি । অস্মিতা এই সব ভাবতে শুয়ে পরলাে ।

অস্মিতাদের বড় বাড়ি । অনেকটা রাজপ্রাসাদের মত । হবেই না কেন , ওর বাবা - মা বড়লােক । বাড়িতে কম করে ১৩ - ১৪ টা ঘর আছে । আর তাতে থাকে মাত্র তিনজন । ওর বাবা - মার দুজনের আলাদা আলাদা ঘর রয়েছে । অস্মিতার নিজস্ব একটা বাথরুম আর একটা বেডরুম রয়েছে । পড়ার ঘর মানে লাইব্রেরির কথাটা বাদই দিলাম । অস্মিতাদের ফ্যামিলি বিজ্নেস রয়েছে । অস্মিতার বাবা - মা দুজনে মিলে সেটাকে সামলায় । নিজের বাবার ব্যবসায় কোন ইন্টারেস্ট নেই অস্মিতার । অস্মিতা পড়াশােনায় মােটামুটি ভালাে । পড়াশােনা শেষ করে এখন একটা আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে । মাইনা মােটামুটি পায় । নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় অস্মিতা । অস্মিতার এই ব্যাপারটা সুমনের খুব ভালাে লাগে ।

অন্যদিকে সুমনের ছােট্ট একটা বাড়ি । বাড়িটা দোতালা । নিচের তলায় ভাড়া খাটে । ওপরে তলায় থাকে সুমন ও সুমনের বাবা - মা । সুমনও একটা এমএনসি কম্পানিতে চাকরি করে । এই চাকরিতেই অনেক স্বপ্ন সুমনের , নিজের বাড়িকে নতুন করে ডেকোরেশন করা কিংবা অস্মিতার সঙ্গে সংসার করা।যেভাবেই হােক না কেন সুমন ওর স্বপ্ন পূরণ করবেই । অবশ্য বাইক কেনার স্বপ্নটা সুমন পূরণ ক ফেলেছে । ক্লাস টুয়েলভ থেকে বন্ধুত্ব অস্মিতা আর সুমনের । ওদের বন্ধুত্বটা কখন ভালবাসায় পরিনত হয়েছে ওরা নিজেরাও জানেনা ।

অস্মিতা ছুটে যায় ব্যালকনিতে ফোনের একটাবার ভাইব্রেশনে । লাইটপােষ্টের হালকা আলােতে দেখে , সুমন ঘরের পড়া জামা আর একটা গেঞ্জির কাপড়ের ফুল প্যান্ট পড়ে চলে এসেছে , ওর সঙ্গে দেখা করতে । আজ ১৭ দিন পর সুমনকে দেখছে অস্মিতা । উস্কোখুস্কো চুল সুমনকে দেখে বেশ ভালাে লাগলাে অস্মিতার । অস্মিতা জানে , সুমনেরও ওকে দেখে খুব ভালাে লাগছে । অস্মিতার খােলা চুল সুমনের খুব পছন্দ । সাধারণভাবেই দেখতে ভালােবাসে সুমন অস্মিতাকে ।
অস্মিতা একঝলক দেখা দিয়েই ঘরে ঢুকে যায় ।

- " কি হলাে ঢুকে গেলি কেন ? .... ব্যালকনিতে আয় । "
- " না । না । আমার লজ্জা লাগছে । "
- " কিসের লজ্জা ? এক মিনিটও দেখতে পারলাম না তােকে । তােকে খুব সুন্দর দেখতে লাগছিল খােলা চুলে । "
- " না , তুই আগে বল কেন এসেছিস ? "
- " বললামই তাে তখন । শুধুমাত্র তােকে দেখতে। "শান্ত গলায় সুমন বললাে ।
- " আচ্ছা ঠিক আছে । আমি চলে যাচ্ছি । যা , তুই রেস্ট নে অস্মিতা , তুই ঘুমা । "
- " না তুই যাবি না । তুই ঘরে আয় । "
- " কি ?? এত রাতে ? আমার তােকে দেখতে ইচ্ছে করছে , তাই জন্য আমি এসেছি । অন্য কিছু না । "
- " আয় না । আমার তাের সঙ্গে অনেক অনেক কথা আছে । "
- " অনেক অনেক কথা আছে ? "
- " হ্যাঁ , অনেক কথা আছে । " বলে অস্মিতা ।
- " আচ্ছা । শুনবাে তাের কথা । তার আগে , আমায় একটা কথা বল । এখন আমি যা বলব সেটা শুনবি তাে ? যা বলব তাই করবি তাে ? "
- " জানা আছে তুই কি বলবি আমাকে । শুনবাে আমি । তুই খালি নিজের ধান্দা খুঁজিস । "
একটু হেসে সুমন বলে - " নােংরা মাইন্ড তাের । আর তুই বলিস আমার মাইন্ড নােংরা । হু । আচ্ছা শােন , যেটা বলছি , হাতের সামনে যে ড্রেসটা আছে সেইটা পড়েই নিচে নাম , এখনই । "
- " মানে এত রাতে আমি রাস্তায় বের হব ?? "
- " প্লিজ ", আবদারের সুরে সুমন বলে ।
- " একটা বার নিচে নাম । খুব দরকার তােকে । "
- " এত রাতে আমি রাস্তায় বেড়াবাে না । তুই আয় না উপরে , তােকে না করছি না তাে । "
সুমন খুব সিরিয়াস গলায় বলে - " তােকে একটা কথা বলার ছিল অস্মিতা । আমি কাল দিল্লি চলে যাচ্ছি । "
অস্মিতা ধপাস করে বিছানার মধ্যে বসে পড়ে । - " তুইও চলে যাবি ? "
- " মানে ? তুইও চলে যাবি মানে ? আর কে চলে যাবে ? তােকে আমি আগেও বলেছিলাম আমাদের কোম্পানি থেকে কাউকে দিল্লি পাঠাবে প্রজেক্ট এর কাজে , সাত দিনের জন্য । এই সুযােগটা আমি পেয়েছি , আমার খুব সৌভাগ্য । হয়তাে ফিরে আমার প্রমােশনটা হয়ে যাবে । তুইতাে সব কিছুই জানিস । "
অস্মিতা চোখের জল মুছে বললাে , " আসছি সুমন , দুটো মিনিট দাঁড়া । "
এই বলে ফোনটা কাটে অস্মিতা । মা - বাবার ঝামেলার কথা সুমন কিছুই জানেনা । এর মাঝে সুমন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে । জানি মাত্র সাত দিনের জন্য তবুও আমি ওকে এক মুহূর্তের জন্য একা ছাড়তে চাই না , সব সময় চাই ও আমার সাথে থাকুক । এইসব কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির বাইরে আসে অস্মিতা ।

- " না গেলে হয় না সুমন ? " অস্মিতা নিচে নামার সাথে সাথে সুমনকে এই প্রশ্নটাই করল ।
- " আগে বাইকে বস , চল আমরা লংড্রাইভে যাব । তারপর সব কথা । "
অস্মিতা চুপ করে বাইকে বসলাে , মুখে কোন কথা নেই ওর । বাইকে বসার সাথে সাথে সুমনের পিঠে নিজের মাথাটা ঠেকালাে ।
- " কিরে কি হল তাের আবার ? "
- " কিছু না । ভালাে লাগছে না । "
- " আরে মাত্র সাতটা দিনের ব্যাপার । যাব আর চলে আসব । "
- " ৭ টা দিন কি কোন দিন না ? তখন বুঝি আমি তােকে মিস্ করবাে না ? তাের কালই যেতে হবে ? "
বাইকে বসা অবস্থায় সুমন অস্মিতার একটা হাত শক্ত করে ধরে বলে- " কথা বলব তাে ফোনে তাের সাথে । দেখতে দেখতে সাতটা দিন কেটে যাবে । "
অস্মিতা কোন কথা বলে না , চুপ করে শােনে ।
- " কিরে কিছু বলবি না অস্মিতা ? "
- " বাড়িতে মা - বাবার ঝামেলা বাড়ছে । তারমধ্যে তুমিও চলে যাচ্ছিস । মন মেজাজ একদম ভালাে নেই আমার । "
- " কি নিয়ে ঝামেলা চলছে ? বিজনে ? নাকি অন্য কোন বিষয়ে ? "
- " ৭-৮ দিন আগে কিছু লােক আমাদের বাড়িতে এসেছিল । ওদের কথা শুনে বুঝলাম ওর এডি কোম্পানি গ্রুপ থেকে এসেছে ... "
সুমন অস্মিতাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, " তােদের কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বি , সেই এডি কোম্পানি ? "
- " হ্যাঁ । আমাদের কোম্পানির শেয়ার পড়ে গেছে , কম্পানি লসে রান করছে , তাই ওরা আমাদের কোম্পানি কিনে নিতে চায় । কিন্তু মা - বাবা চাইছে না বিক্রি করতে । মা - বাবা চাইছে আমাদের কোম্পানিটা যেন দুই ভাগে বিভক্ত হয় । যাতে দুটো আলাদা নামে কোম্পানিটা দাঁড়ায় । "
- " তাে এখানে ঝগড়ার কি আছে ? "
- " আমার কথা শেষ হয়নি , সুমন । "
- " সরি , শুনছি , বল । "
- " আমার মা - বাবার নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক একটু আলাদা । বিজনেসটা ওদের কাছে বড় । বিজনেসটা ঠিক রাখার জন্য ওরা এখন মিউচুয়াল সেপারেশন চায় । "
সুমন বাইকে আচমকা ব্রেক চাপে । " কম্পানি বাঁচানাের জন্য ডিভাের্সের কি দরকার ? এই কথাটার কোন মানে হয় ? পাগল হয়ে গেছে নাকি তাের মা বাবা ? "
- " জানিনা রে । "
অস্মিতা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল - " জানিস সুমন , এই কয়েকদিনের মধ্যে মা দুবার আমাকে এসে জিজ্ঞাসা করে গেছে যে আমি কার কাছে থাকতে চাই ? .... আমি কি চাই সেটা জানতে চায় না । যদি মা - বাবার সম্পর্ক বাঁচানাের জন্য আমাকে এই বিজনেস জড়াতে হয় , আমি তাতে রাজি । চাইনা আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে , চাইনা আমার এই আইটি কোম্পানির চাকরি । কিছু করেই হােক আমাকে , আমার মা বাবার মাথা থেকে বিচ্ছেদের ভাবনাগুলাে সরাতে হবে । "
অস্মিতা বলে চলে, " আমি আমার মা - বাবাকে খুব ভালােবাসি । আমি ওদের মধ্যে কোন একজনকে বেছে নিতে চাই । আমার যা যা করার দরকার আমি তাই তাই করবাে , নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করব , আমি মা বাবাকে হারাতে চাইনা । "
- " অস্মিতা , কাকু কাকিমার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে দেখেছিস ? "
- " না । "
- " আগে একবার কথা বলে দেখ । আসল সমস্যাটার কথা জান । তাের সব কথা শুনতে আমি রাজি আছি , কিন্তু আমার সামনে কাঁদবি না , ভালাে লাগেনা আমার ।.... চল , বাড়ি চল । আর একটু পরেই ভােরের আলাে ফুটবে । আমার ফ্লাইট কাল সকাল নটায় । "
- " সব ঠিক হয়ে যাবে বল ? "
- " হ্যাঁ , সব ঠিক হয়ে যাবে । এত চিন্তা করিস না । আমিতাে আছিই । "
সুমন হাসিমুখে অস্মিতার গালে হাত দিয়ে চোখের জল মােছে ।
বাড়ির সামনে এসে অস্মিতা - " যাওয়ার আগে ফোন করিস । সব সময় ফোন করবি । "
- " আচ্ছা মা , যখনি সময় পাব , আগে আপনাকে ফোন করবাে । ঠিক আছে ? "
অস্মিতা উত্তর না দিয়ে বাড়ি ঢুকে যায় । সুমনও নিজের বাড়ির দিকে রওনা দেয় । সকাল দশটার পর ঘুম ভাঙে অস্মিতার । দশটা মিসকল অস্মিতার ফোনে । ফোনে পেল না সুমনকে । কালকে রাতে কথা গুলাে যেন কিছুতেই অস্মিতার মাথা থেকে নামতে চাইছিল না । প্রতিমুহূর্তে শুধু একটাই কথা মাথায় এসছিল ওর যেভাবেই হােক সবকিছু ঠিক করতে হবে । নিচে নামতেই - বাবাকে একসাথে দেখে ভালাে লাগে অস্মিতার । কিন্তু এক - দুবার দেখার পরেই ভালাে করে বুঝতে পারে ওদের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্বটা । অফিসে যাওয়ার পথে সুমনের সঙ্গে কথা হলাে ওর । কোনরকমে দিন কাটিয়ে বাড়ির পথে ও ঠিক করল মায়ের সঙ্গে কথা বলবে ।

মায়ের ঘরে দরজা ধাক্কাতেই , - " ভিতর আয় । "
- " একটু কথা ছিল মা । যা বলার তাড়াতাড়ি বলাে , অনেক রাত হয়েছে । আমার অনেক কাজ আছে । কাল সকালে অফিসেও তাড়াতাড়ি যেতে হবে । "
- " অফিসে কি সমস্যা হয়েছে মা ? "
- " আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন ? এর আগে তাে কখনাে আমাদের বিজনেসের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করনি অস্মিতা ? "
- " এর আগে কখনাে প্রয়ােজন মনে হয়নি মা । "
- " কি জানতে চাও বলাে । " 
- " কিছু জানতে চাই না , শুধু বলতে চাই । " অস্মিতা ভাঙ্গা গলায় কথা বলে ।
এতক্ষণ অস্মিতার মা , ওর মুখের দিকে তাকায় নি । অস্মিতা চোখে চোখ রেখে ওর মা বলল- " বলাে কি হয়েছে । "
- " বাবার সঙ্গে তােমার কি হয়েছে ? ডিভাের্সের কথা কেন বলছ ? "
- " ফ্যামিলি বিজনেসটা ভেঙে যাচ্ছে অস্মিতা । দুটো ভাগ হয়ে গেলে সেটা একটু স্টেবল হবে । সেটার জন্যই এই ডিসিশন । এছাড়া আরাে অনেক কারন আছে । "
- " তুমি বুঝতে পারছ না তার জন্য বলিদান যে আমি হচ্ছি ৷ " মনে মনে কথা ভাবল অস্মিতা , কিন্তু বলার সাহস পেলাে না । মুখে অন্য কথা বলল ও- " এ ছাড়া কোন উপায় নেই মা ? "
- " এটা না করলে এডি কোম্পানি গ্রুপ আমাদের কোম্পানি কিনে নেবে । কম্পানি শেষ হয়ে যাবে । "
- " আর আমার কি হবে ? "
এই প্রশ্নের কোন উত্তর পেলােনা অস্মিতা।
- " এখন ঘুমাতে যাও , অনেক রাত হয়েছে । "
আর কোন কথা বলার সাহস পেলােনা অস্মিতা ।

রাতে সুমনের সঙ্গে ওর কথা হলাে । প্রতিটা দিন অস্মিতার কাছে বছরের মত লাগছে । পরের দিন , অস্মিতা ঠিক করল বাবার সাথে কথা বলবে । বাবাকে ও যমের মতাে ভয় পায় । কি কথা বলবে নিজেও জানেনা ও , তাও বাবার ঘরের সামনে যেতেই বাবা বেরিয়ে এল ।
- " তুমি এখানে ? কিছু বলবে ? কিছু বলার থাকলে তাড়াতাড়ি বলাে অফিসে যেতে হবে । "
- " না , সেরকম কিছু না । " অস্মিতা ভয়ে কিছুই বলতে পারলােনা বাবার সামনে । ওর বাবা পাশ কাটিয়ে চলে গেল নীচে । 
অস্মিতা কাছে যেন কিছুই করার নেই , যদি কিছু করার থাকে সেটা শুধু প্রার্থনা । সুমনের অনুপস্থিতটা ওকে আরাে অশান্ত করে তুলছিল । সুমনের সঙ্গে এতদিন কথা না বললেও সুমন যেন মনের কাছে ছিল , আজ সামান্য দূরে যেতেই ... নিজের কাছের মানুষটা দূরে চলে গেলে কতটা অস্বস্তিকর লাগে সেটা ভালােমতাে বুঝতে পারেছে ও । নাজানি আরও কত কথা মাথায় চলছিল । সুমনকে সমস্ত কথা বলতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু সুমন ওর ফ্যামিলি ম্যাটার খুব একটা পছন্দ করেনা । অস্মিতার সুমন ছাড়া বন্ধুবান্ধব বলতে কেউ নেই এসব কথা ও কাকে বলবে !!

মা - বাবা ঝামেলাটা যেন দিনকে দিন বাড়ছে । জানিনা কি বিষয় এত চিল্লাচিল্লি হল মা - বাবার মধ্যে । কিছু ভালাে লাগছে না , জানিনা এটা কতদিন চলবে । বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব কথা ভাবতে অস্মিতা চোখের জল ফেলে । তার ওপর সুমনের সঙ্গে আজ ওর কথা হবে না , সুমন আজ খুবই ব্যস্ত থাকবে । আজকে রােববার অফিসটাও বন্ধ । অফিসে থাকলে হয়তাে একটু মন অন্যদিকে থাকতাে । পরেরদিন , বাবা - মা আজ একসাথে অফিস গেল । সকালেই বেরিয়েছে , দেখে মনে হল কোন মিটিং আছে হয়তাে । অস্মিতাও অফিসে চলে গেল তাড়াতাড়ি । সুমনের সঙ্গে আজ ওর অনেকক্ষণ কথা হয়েছে । অনেক গল্প হয়েছে , মন মেজাও একটু ভালাে ছিল গত দুদিনের থেকে বাড়ির কথাটা প্রায় ভুলেই গেছিল অস্মিতা , যদি না মা ফোন করতাে । বাড়িতে এসেই একেবারে অস্মিতার মায়ের সঙ্গে ওর কথা হলাে ।
- " ফোন করেছিলে আমাকে ? "
- " হ্যাঁ । তখন একটু দরকার মনে হয়েছিল । "
- " কিছু বলবে ? - " এখনাে কিছু ফাইনাল হয়নি আর একটা দুটো দিনের মধ্যে জানতে পারবে । "
অস্মিতা যে ভয়টা পাচ্ছিল হয়তাে সেটাই সত্যি হবে ? বাবা - মা এত তাড়াতাড়ি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ?
- " আমি তােমাদের দু'জনকেই ভালােবাসি । কেন ছাড়াছাড়ি করছাে তােমরা ? "
ওর মা হেসে ফেললাে- " আমার মতে , এত সহজে সম্পর্ক ভাঙা যায় না । নতুন সম্পর্ক গড়া অনেক সহজ । ঘরে যাও , ঘুমাও , রাত হয়েছে । "
এই হাসির অর্থ অস্মিতা বুঝতে পারল না । যদি সবকিছু ঠিক হয়ে যায় তাহলে খুব ভালাে হবে । মনে মনে একটু হলেও খুশি হলাে অস্মিতা । আজকের দিনটা ওর ভালােই গেল । অপেক্ষার আর মাত্র দুটো দিন , তারপরেই সুমন কলকাতায় । আর কোনরকমে দুটো দিন কেটে গেলেই হল । আজও ওর মা - বাবা একসাথে অফিস গেল । এইটুকু আন্দাজ করতে পারলাে কোন ব্যাপার হয়েছে । সম্পর্কটা যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে খুব খুশি হবে অস্মিতা । অফিসের ঝামেলাটাও যেন মিটে যায় প্রতিদিনের মত আজও অস্মিতা অফিসে গেল । ওর মনে শুধু একটাই কথা চলেছিল আর মাত্র দুদিন বাকি । অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই ওর মা ওর ঘরে এসে হাজির ।
- " তিন দিনের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিও অস্মিতা । "
- " হঠাৎ ছুটি নেব কেন মা ? "
- " কাল জানতে পারবে । বাবাও তােমার সঙ্গে কথা বলবে একটু । আমি সবটাই জানি কিন্তু এখন কিছু জানতে চাইছি না । "
অস্মিতা কিছুই বুঝতে পারছিল না কি বলছে ওর মা ।
- " আমাকে কি তােমাদের সাথে কাল অফিসে যেতে হবে ? "
- " এখন সেটা বলতে পারবাে না । হয়তাে যেতে হতে পারে । কাল বাবার কাছেই সবটা শুনাে । "
সুমনের ফোন আসতেই , মাকে বলল- " আচ্ছা ঠিক আছে কাল কথা হবে । " অস্মিতার অনেক কথা হল সুমনের সাথে । বাড়ির ব্যাপারটা কিছুই জানালাে না ।
রাতে সেই ভাবে ঘুম হলাে না অস্মিতার । মন মেজাজটাও খুব ভালাে ছিল । শুধু এইটুকুনি প্রার্থনা করেছিল কোন কিছু খারাপ যেন না হয় । সকালে ব্রেকফাস্ট এর সময়েই মা - বাবার সামনে জিজ্ঞাসা করল- " আমাকে কি অফিসে যেতে হবে তােমাদের সাথে ? "
বাবা উত্তর দিল - " না । অফিসে যাওয়ার কথা কে বলেছে তােমাকে ? মা ? " মাথা নাড়লাে অস্মিতা ।
- " তােমার জন্য সুখবর আছে । আজ রাতে সমস্ত কিছু বলবাে । আর একটু অপেক্ষা করাে । "
মনে মনে অস্মিতা বলল তাহলে অফিসে ছুটিটা নিতে গেলাম কেন , বাড়িতে বসে থাকার জন্য !
রাতে অস্মিতা বাবা - মার জন্য অপেক্ষা করছিল । বাবা - মা বাড়ি ফিরতেই - " আজকে কি হলাে অফিসে ? কি বলবে তুমি আমাকে ? "
বাবা হাসিমুখে বলল- " অপেক্ষা করাে জানতে পারবে । ফ্রেশ হয়েনি তারপর ঘরে গিয়ে বলছি । "
অস্মিতা মনে মনে খুব খুশী হলাে বাবার হাসি মুখটা দেখে । মােটামুটি বুঝতে পারল সব ঠিক হয়ে গেছে । খুশিটা আরাে দ্বিগুণ হবে কারণ কালকেই সুমন চলে আসবে কলকাতায় । অস্মিতার প্রার্থনা কাজেই লেগেছে ।
১৫ মিনিট পরেই বাবা - মা দুজনেই অস্মিতার ঘরে হাজির হলাে ।
- " তােমার জন্য সুখবর আছে । "
- " সেটা কি বাবা ? যার জন্য আমাকে অফিস অফ করতে হলাে ! "
- " তােমার বিয়ে ঠিক করেছি । "
অস্মিতা প্রস্তুত ছিলনা এই কথাটা শােনার জন্য । উঠে বসলাে বিছানার উপর । " কি ? " অস্মিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাে ।
- " এডি কোম্পানির ... " ওর বাবাকে থামিয়ে ওর মা বললাে- " কি হলাে ! এভাবে । তাকিয়ে আছিস কেন ? নতুন সম্পর্ক করা অনেক সহজ বলছিলাম না , এটাই বােঝানাের চেষ্টা করছিলাম । আমরা তাে তাের ভালাে চাই । নাকি ! "
অস্মিতা চুপ করে শুনছিল । কোন কিছু বলার ভাষা ছিলনা ওর ।
ওর বাবা জিজ্ঞাসা করল- " কিরে মনা , কিছু বলবি না ? "
অস্মিতার গলা দিয়ে স্বর বেরােচ্ছিলনা- " হ্যাঁ ? কি বলবাে ? তােমরা , খুশি তাে ? "
ওর মা হাসিমুখে বলল- " খুব ভালাে ছেলে দীপক । সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে আমরা সবাই খুব খুশি হব । দাঁড়া , ওর ছবি দেখাই । "
- " রাত হয়েছে মা । কাল কথা হবে এখন যাও । "
- " কি হলাে ? ছবিটাও দেখবি না ? "
- " ভালাে লাগছে না । "
- " আচ্ছা তুই ঘুমা । রেস্ট নে । "
মা - বাবা চলে যাওয়ার পরে , বিছানা ছেড়ে অস্মিতা আয়নার সামনে দাঁড়ালাে । ওর চোখের জল, গাল ছুঁয়ে মাটিতে পড়ল । আয়নাতে ও অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছিল । আয়নায় ঘড়ির প্রতিচ্ছবিতে ও দেখল প্রায় রাত একটা বাজে । সুমনের কলকাতায় আসতে আরাে ১০ ঘণ্টা বাকি ।
                                    সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !