জঙ্গলের বিভীষিকা (অন্তিম পর্ব)


অন্তিম পর্ব

হারাধন আওয়াজ দিয়ে বলল - "আমরা এখানে আছি, এদিকে সামনে। ঝোপের আড়ালে।" নিমাই আর বরুণ হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের কাছে ছুটে এসে বলল - "কখন থেকে তোমাদের খুঁজছি, কোথায় ছিলে?" হারাধন সবটা বলল। শুনে নিমাই বলল - " তবে ও কাজ শয়তানটারই " সে বলে চলে - " আমরা বন মরগের পিছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে জঙ্গলের ভিতর এমন এক জায়গায় এসে পড়েছিলাম যেখানে হাড়, মাংস সব পরে। দুর্গন্ধে পেট গুলিয়ে উঠছিল। আরো ভিতরে যেতেই দেখি ছিন্নভিন্ন দুটো শরীর ।ঘাড় থেকে পাঁজর পর্যন্ত কেও হাড়-মাংস খুবলে খেয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি ...।" সে আর বলতে পারে না। কান্নায় স্বর বুজে আসে।

ওরা সবাই নৌকার কাছে গেল। দুটো লম্বা গাছের ডালের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা আছে দুটো দেহ। শক্ত লতা পাতা দিয়ে বাঁধা। নিমাই আর বরুণ এভাবে বেঁধেই এখানে নিয়ে এসেছে। 

একটা নৌকায় দুটো দেহকে নিয়ে নিমাই এগিয়ে চলল। অন্য নৌকায় বাকিরা। আজ নদীর দুই পারের ঝোপের উপর, গাছের ওপর জোনাকির ঝাঁক নেই। ঝি-ঝি রাও চুপ। শুধু দাঁড় টানার শব্দ আসতে থাকল কানে। যেতে যেতে নবীন আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ আজ অনেকটাই পরিষ্কার। খালি দু'একটা কালো মেঘ চাঁদ আড়াল করছে আবার সরে যাচ্ছে। 

শেখররা বাড়ি ফিরে দুই বন্ধুর দেহ সৎকার করে। রাত্রিটা নবীন শেখরদের ওখানেই থাকে। পরদিন ভোর হলে হারাধন, নবীনকে নিয়ে বেরিয়ে যায়, তার অফিসের উদ্দেশ্যে। স্রোতের অনুকূলে নৌকায় করে খুব তাড়াতাড়ি একটা গ্রামে আসে।একটা লোককে নবীন তার অফিসের ঠিকানা বলে। নবীনকে পৌঁছে দেবে শুনে, হারাধন নৌকা নিয়ে ফিরে যায়। 

নবীন তার অফিসের চাবিকাঠি জঙ্গলেই হাড়িয়ে ফেলেছিল, তাই তালা ভাঙা ছাড়া উপায় নেয়। নবীন তাই করল। তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকলো। দু'দিন আগে ভরে রাখা বোতলের জল গলায় ঢালল। "আঃ, কি তেষ্টাই না পেয়েছিল!" প্যান্ট জামা ছেড়ে চেয়ারে বসতে যাবে, ট্রেনের হর্নের আওয়াজ তার কানে এল। দেওয়াল ঘরিটার  দিকে তাকিয়ে দেখে ৮:৫০। এখানে ট্রেন ১০-২০ মিনিট প্রায় লেট করে আসে। নবীন বাইরে বেড়িয়ে এল। নবীনকে দেখতে পেয়ে টিকিট মাস্টার নেমে এলেন, বললেন - "কী ব্যাপার নবীন বাবু? পরপর দু'দিন, আগের রাতেও থাকনি। শরীর খারাপ নাকি? আরে তোমার মাথায় কী হয়েছে? কাপড় বাঁধা যে। কপালটাও  ফুলো ফুলো লাগছে, পরে টরে গেছ নাকি?" ভোরে ফেরার আগে হারাধন নবীনের মাথায় কাপড় বেঁধে দিয়েছিল। নবীন ধীরে ধীরে বলল - "হ্যাঁ, এই একটু পরে গিয়েছিলাম।শরীরটাও খারাপ। একবার বাড়ি যেতে পারলে ভাল হয়।" 

টিকিট মাস্টার - "নতুন জায়গায় এলে প্রথম প্রথম শরীর খারাপ হয়। এখানে তো আবার সেরকম ডাক্তার নাই। তবে, তুমি যখন বাড়ি যেতে চাইছ, তাহলে এখনই চলে এসো। আমি না হয় সাক্ষী দিয়ে দেব।" 

নবীনকে বাড়ি যেতে হলে সকালের ট্রেনেই যেতে হবে। তাই সে তাড়াতাড়ি অফিসে ঢুকে তার ব্যাগ পত্র নিয়ে নিল। অফিসের গেটে অন্য একটা তালা ঝুলিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল।

বাড়িতে পৌঁছে নবীন তার উপর মহলে দুটো চিঠি পাঠাল, একটা তার অনুপস্থিতর কারণের আর অন্যটা তার পিস্তলটা হারিয়ে যাবার জন্য।

নবীনের মনে এখন অনেক প্রশ্ন। কেও কি তার কথা বিশ্বাস করবে? এই যে, সে অমন জানোয়ার দেখেছে। তার হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে। নবীনের মাথা ধরে আসে। আর কিছু ভাবতে পারে না।বিছানাই শুয়ে পরে। কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসে না। ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বার করে অনলাইন হয়। ইন্টারনেটে সার্চ করতে থাকে। তবে, তেমন কিছুই সে পায় না যেটার সাথে জানোয়ারটার মিল থাকে।নিরাশ হয়ে শাট ডাউন করতে যাবে এমন সময় তার মাথায় একটা খেয়াল এল, সেই জ্বলে থাকা মাশরুমের। সে সার্চ করতে থাকল। কতগুলো ছবিও পেল সে প্রায় একই রকমের। একটার পর একটা আর্টিকেল পড়তে থাকল। পড়তে পড়তে এক জায়গায় এসে তার চোখ আটকে যায়। সেখানে লেখা আছে, পৃথিবীর প্রায় ১৪০০০ প্রজাতির মাশরুমকে শনাক্ত করা ‌হয়েছে। তাদের মধ্যে এমন কিছু প্রজাতি আছে, যাদের ভীষণই অন্ধকারে, যেখানে বছরের পর বছর সূর্যের আলো পরেনি এমন পরিবেশে পাওয়া গেছে। এরা সাধারণ মাশরুমের মতোই লম্বা হয়। বাইরে থেকে দেখে অন্য সাধারণ মাশরুম মনে হলেও তাদের ভিতরের গঠন বিজ্ঞানীদের অবাক করেছে। এদের মধ্যে থাকা 'লুসিফেরিন' নামক যৌগ, যা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে উৎসেচক 'লুসিফেরাস'-এর সাথে মিথস্ক্রিয়ায় সবুজ আলো তৈরি করে। এরা একটা সময়ের পর এক বিশেষ মিষ্টি গন্ধ বাতাসে মিশিয়ে দেয় যার মধ্যে থাকে রেনু যা তাদের বংশ বিস্তারে সাহায্য করে। তবে, এই গন্ধে আর এক বিশেষ উপাদান আছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, তা জীবের জেনেটিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। তাতে জীবের শারীরিক এবং মানসিক দুইয়েরই ভয়ংকর পরিবর্তন ঘটতে পারে।

তবে, এ বিষয়ে গবেষণা এখনও চলছে। যদি বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে সফল হন ,তবে এ হবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য আবিস্কার। 

এই পর্যন্ত পড়ে নবীন নিজেই নিজেকে বলে উঠল - "তবে কি ওই মাশরুমের গন্ধই জানোয়ারটার অমন ভয়ংকর চেহারার জন্য দায়ী? কিন্তু, এই দুটো মাশরুমের যে একই প্রজাতির সেটাও কোনো ঠিক নেই। ঠিক হলেও, ওটা প্রথমে কী‌ ছিল? শিয়াল নাকি নেকড়ে? কিন্তু, নেকড়ে আসবে কোথা থেকে?

হঠাৎই তার হারাধনের বলা কথাটা মনে পরে গেল। হারাধন বলেছিল, সে একবার উত্তরে পাহাড়ের ওখানে নেকড়ে দেখেছিল। তবে, কি সুরঙ্গ উত্তরে পাহাড় পর্যন্ত গেছে? কোনো ভাবে সেটা সুরঙ্গে এসে পরেছিল। কিন্তু নেকড়ে বা শিয়াল যাই হোক না কেন তাদের তো চোখ আছে। তবে? 

নাকি ও জীব আমাদের এই আলোক জগতের নয়! ভূগর্ভস্থ কোনো অজানা আদিম অন্ধকার জগতের?"

একমাস কেটে গেছে। নবীন তার কাজের জায়গায় ফিরেছে। সেখানে আর কারোর গবাদি পশু,পাখি নিখোঁজ হচ্ছে না। এর মধ্যে সে বিজ্ঞান মহলে ওই মাশরুম সম্পর্কে চিঠি দিয়েছিল। তাদের টিম এসে স্যাম্পল নিয়ে গেছে পরীক্ষার জন্য। এদিকে নবীনের এক সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার ডাল-তরকারি ভাতে অরুচি এসেছে। কিছুদিন যেতে না যেতেই তার মাথার চুল অনেকটাই বেড়ে গেছে। গায়ের লোমও। কিন্তু, এ বিষয়ে তার কোনো খেয়াল নেয়। সবটাই যেন স্বাভাবিক।

সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !