জাপানি কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা


লেখক: শংকর ব্রহ্ম


          জাপান হ্রস্বতম কবিতার দেশ, হাইকুর দেশ। অন্যদিকে আমরা জানি, উদিয়মান সূর্যের দেশ, চেরী ফুলের দেশ।

           জাপানী কবিতা অন্যান্য দেশের কবিতার মতো নয়। সে দেশের কবিতা অবিমিশ্র-কাব্যিক ও অকাব্যিক কোন বিবেচনা প্রসূত নয়। কবিতার আকৃতি এখানে মূলতঃ হ্রস্বতম। এদের কবিতা চীনের কবিতার কাছে ঋণী হলেও জাতীয় মানসিকতায় পরিস্রুত। জাপানী কবিতা চীনের মতোই সংযত। ফলে তাদের কবিতায় অনেক কিছুই অনুক্ত। এক ফুলের কলির বিকাশে, সমগ্র বসন্তকে ধরার চেষ্টা। সন্ধ্যা ঝরা পাতার দৃশ্য বর্ণনায় হেমন্তকে ধরার প্রচেষ্টা। ঘাসের উপরে শিশির ফোটার দৃশ্যে সমগ্র জীবনের অনিত্যকে ধরার চেষ্টা।

          জাপানে কবিতা চর্চা সমাজের সকলেই করে।

          কবি বলে আমাদের মতো, ওখানে কোন রকম কোন আলাদা সম্প্রদায় নেই। সকলেই মোটামুটি লিখতে পারেন। অনুভূতির প্রাধান্য ও ছন্দের সারল্যই এর মূল কারণ।

          জাপানের বেশীর ভাগ কবিতাই 'তানকা' বা 'ওয়াকা'। পাঁচ পংক্তিতে (৫-৭-৫-৭-৭) মোট একত্রিশ মাত্রায় রচিত। তাছাড়া 'হাইকু' (৫-৭-৫) মোট সতেরো মাত্রা, লেখার চলও আছে। 

          জাপানের প্রাচীনতম কবিতা সংগ্রহ 'কোজিকি' (৭১২ খ্রীষ্টাব্দে সংকলিত)। এর আগেও কবিতা মৌখিক ভাবে প্রচলিত ছিল, তবে তা লিপির অভাবে তখন লিপিবদ্ধ হতে পারেনি।

          ৭৫৯ খ্রীষ্টাব্দে সংগৃহীত 'মানয়োও শুউ' (দশ হাজার পত্র সংগ্রহ) পৃথিবীর অন্যতম কবিতা সংগ্রহ।

          তানকা হলো জাপানি সংক্ষিপ্ত কবিতা। (প্রশ্ন: তানকা কি? উত্তর: উত্তেজনাপূর্ণ, ঠিক যেন টি-টুয়েন্টি।)

          জাপানিরা মনের ভাব সংক্ষেপে প্রকাশ করতেই বেশী পছন্দ করে। 'কথা কম কাজ বেশী', এই নীতিতেই তারা বিশ্বাসী। মানে অল্প কথায় ভাবের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে চায় তারা তাদের গীতি-কাব্যে।তাই জাপানকে বলা হয় 'হ্রস্বতম কবিতার দেশ।'

          তানকার ফর্মটি (৫-৭-৫-৭-৭) মূলত ওয়াকা (waka) ফর্ম থেকে এসেছে। জাপানিরা গীতি-কাব্য হিসাবে তানকার ব্যবহার করতো,সেই অনুযায়ী ধ্বনিবিন্যাসই শ্রেয়। জীবনের সুখ দুঃখ, আশা-আকাঙ্খা, হতাশা, প্রতিবাদ, আনন্দ, উল্লাস, নৈতিক অবক্ষয়, সবগুলিই তানকার বিষয় হতে পারে অনায়াসে। 

          তানকায় (৫-৭-৫) -কে জাপিনিরা upper phrase (কামি নো কু)-য়ে বিষয়বস্তু। (৭-৭) -কে বলে lower phrase (শিমো নো কু)-য়ে সারমর্ম। প্রথম তিন লাইনে বা চরণে প্রকাশ পায় বিষয়বস্তু, ভাবমূর্তি, রূপ-প্রতিরূপ, প্রতিচ্ছায়া-প্রতিচ্ছবি বা কথামালা এবং পরের দুই লাইনে প্রকাশ পায় সারমর্ম। তানকা বিষয়ের দিক থেকে জোর দেয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঋতুবৈচিত্র, জীবনের আশা নিরাশা প্রভৃতিকে।  


তিন প্রজন্মের তিনটি তানকার উদাহরণ:

------------------------------------------------------


১)


ক্লান্তি বিহীন

গাও হে কোকিল।

এক বছরে

দুবার কখনো কি

বসন্ত আসে বলো?


(ফুজিয়ানা নো ওকিকাজে - ৯১০)


২)


বিবর্ণ ফুল

আনমন হৃদয়ে

জগৎ দেখে,

সুবিশাল আকাশে

বসন্ত আসে ছুটে।


(রাজকুমারী শিকুশি - ১২০১)


৩)


এপ্রিল দূরে

মে মাসে বৃক্ষশাখা

ফুল শয্যায়

দিশাহারা নয়নে

অপেক্ষায় থাকে যে।


( মায়েদা য়ুউগুরে - ১৯৫১)


          জাপানিরা গীতি-কাব্য হিসাবে ধ্বনিবিন্যাসে তানকা লিখেছেন ঠিকই, তবে বর্ণবিন্যাসেও আজকাল তানকা ও হাইকু লেখা হচ্ছে বাংলা ভাষায়। আমরা যেহেতু তানকা বা হাইকুকে গীতি-কাব্য হিসেবে ব্যবহার করি না, সেই কারণে বর্ণবিন্যাসে লেখা হাইকু বা তানকা বাংলায় চলে যায়। 

          হাইকু(Haiku) হল ওয়াকা ফর্মের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফর্ম। 

          হাইকুতে (৫-৭-৫) সতেরোটি ধ্বনি আর তানকাতে ( ৫-৭-৫-৭-৭) একত্রিশটি ধ্বনি (সিলেবল) থাকে। এগুলি জাপানিদের আবেগপূর্ণ গীতি-কাব্য ।


তিন প্রজন্মের তিনটি হাইকুর উদাহরণ:

----------------------------------------------------


১)


মাঝ রাত্তির

সমুদ্রে জলরাশি

উত্তাল হলো।


(রানসেৎসু - ১৬৫৩)


২)


পাখা ওয়ালা

এক বোবা হাওয়া

অসহ্য তাপ।


(কাকো - ১৭০০)


৩)


সহসা সূর্য

অচেনা ফুলদলে

কবিতা লেখে।


(বাশো - ১৮৯৪)


          জাপানিরা 'সেনরু' নামে এক পংক্তির কবিতা লিখেছেন বহু। সেগুলি জনসমাজে খুবই জনপ্রিয়। মানুষের মুখে মুখে ঘোরে, আমাদের বাংলার প্রবাদের মতো। তবে বেশীর ভাগ লেখকরই পরিচয় জানা যায় নি।

          এখানে কয়েকটা জাপানি সেনরু-র উদাহরণ দিলাম। 


পাঁচটি 'সেনরু'-র উদাহরণ:

------------------------------------


১)


সোহাগ করলে মেয়েটার কথা বেড়ালের মতো হয়,না হলে মেঘ গর্জন।

- অজ্ঞাত।


২)


বাজিয়ে জাগায় বাপ,বাঁশিটি সদ্য কেনা শিশুর জন্য। - শোকি।


৩)


দুজনে বেরোব, স্বামী কথা বলে আয়নার সাথে। 

- সেইকো।


৪)


মেয়ে দেখতে এসে, মাকে পছন্দ হল শেষে।

- অজ্ঞাত।


৫)


স্ত্রী রাতেই থিয়েটারে যায়,স্বামীকে নেয় না সঙ্গে। 

- হাম্পনসেন।


          জাপানের কবিতা মূলতঃ চিত্রকল্প প্রধান। জাপানের প্রাচীন যুগের প্রতিভাধর কবিরা হলেন, হিতোমারো, য়াকামোচি, ওকুরা প্রমুখ।


হিতোমারো (জন্ম: ৬৮১ - মৃত্যু সাল জানা যায়নি)

---------------------------


১)


প্রভাত-ঘুমের কেশ

আঁচড়াব না তো,

লেগে আছে

সুরূপ প্রিয়ের

বাহু-বালিশের পরশ।


২)


আকাশ সাগরে

ঢেউ-তোলা মেঘে

চাঁদের জাহাজ,

তারার অরণ্য দিয়ে

দাঁড় বেয়ে যায়।


য়াকামোচি (৭১৮ - ৭৮৫)

---------------------------


১)


সন্ধ্যা এলে

আগেই দুয়ার খুলে

প্রতীক্ষায় থাকি -

সে বলেছে আসবেই

স্বপ্নে দেখা দিতে।


২)


ছল করে বলেছি

'যাই তো দেখি

কি হাল হয়েছে

বাঁশের বেড়ার'

আসলে তোমার দেখা।


ওকুরা (৬৬০ - ৭৩৩)

-----------------------


দুর্গত

--------


যদিও প্রবাদ -

এ আকাশ,পৃথিবী বিশাল,

আমি তো দেখেছি তারা

গুটিয়েছে আমার উপর।


যদিও প্রবাদ -

চন্দ্র- সূর্য দ্যুতিময় 

আমি তো দেখছি তারা

আমার উপর যেন কিরণ বিমুখ।


সব মানুষেরই কি এই দুর্ভোগ

নাকি আমর একার?

পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি মানুষের

ক্ষেতে খামারে করেছি

কঠোর শ্রম সকলের মতই।

তবু আমার পোষাক

মোটা পাটের সূতোর

পাতলা জ্যালজ্যালে ফতুয়া

কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলে

শতচ্ছিন্ন টুকরোয়

সমুদ্রের কর্কশ শ্যাওলা

এর চেয়েও ভাল।


আমার বাড়িটা চালাঘর

ছড়ানো খড়ের নীচে

নগ্ন শীতল মাটিতে

নীচু ছাদ অর্ধেক নেমেছে।

উপরে আসনে 

বাবা মা বসে গুটিশুটি

আর নীচে 

স্ত্রী ছেলে মেয়েরা

বসে আমার গা ঘেঁষে

নির্দয় কান্নায়।


ঘরের উনুনে

আগুন তোলে না ধোঁয়া

হাড়িতে একাকী

মাকড়সা জাল বুনে চলে।

আমরা ভুলেছি 

রান্না করাটাও

রাতের চড়াই হয়ে

ক্ষীণ কান্নায় ভাঙি।

তবুও এই শেষ নয়

দুর্দশার চূড়ান্ত পর্যায়ে।

লোককথা -

ছোটকে ছোট করতে গিয়ে

দরজায় লাঠি হাতে

ভীমমূর্তি রাজ-পেয়াদা

হাক পাড়ে

জাগো, খাজনা দাও।


এই কি তবে জীবন হবে

সাধ্যাতীত, আশাহীন

এই কি জগতের রীতি?


উপসংহার -

আমরা ভাবতে পারি কেউ

জীবন বেদনাময়

আমাদের ভাগ্য লজ্জাকর,

মানুষ তো পাখি নয়

যে উড়ে গিয়েও মুক্তি পাবে।


          হেইয়ান যুগে (৯১৭- ১১৮৫) দেখা গেছে একটা আশ্চর্য ব্যাপার, পুরুষরা কাব্য রচনা করত চিনা ভাষায়, আর মহিলারা করত জাপানী ভাষায়।

          ৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে 'ৎসুরায়াকি' সংকলিত 'কোকিন শুউ' (প্রাচীন ও আধুনিকদের একত্রিত কাব্য সংকলন)। কামাকুরা (১১৮৫- ১৩৩৩)যুগের মাঝামাঝি থেকেই 'তানকা'র ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। মোরুমাচি (১৩৩৩-১৬০০) যুগে রেঙ্গা বা যুক্ত কবিতার খুব প্রচলন হয়। রেঙ্গা মূলতঃ তানকা, প্রথম তিন পংক্তি একজনের বাকী দুটি অন্যের।

          তোকুগাওয়া (১৬০০-১৮৬৮) যুগে কবিতার তেমন উন্নতি হয়নি। এ যুগের বৈশিষ্ট হলো, 'এদো' ও 'সেনরু'। দু'টিই হাইকু ধরণের কবিতা। 'এদো' সম্পূর্ণ ব্যাঙ্গাত্মক লেখা। 'সেনরু'- এ ফুটে ওঠে জীবনের অন্তর্দৃষ্টি। জাপানি সাহিত্যের মূল ধারা নয় বলে 'এদো' ও 'সেনরু'র অবক্ষয় ঘটে পরবর্তীকালে।

          সম্রাট মেইজীর রাজত্বকালে মেইজী যুগে (১৮৬৮-১৯১২) খ্রীষ্টাব্দে দেশে বিরাট পরিবর্তন আসে, (রুদ্ধদ্বার খুলে গিয়ে) জাপানি কৃষ্টির পুরর্জীবন ঘটে, আধুনিকতাবাদের শুরু হয়। ইউরোপীয় কাব্যানুবাদের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ কবিতা লেখার প্রচলন ঘটে। নাম হয় ' শিন তাই শি' অর্থাৎ 'নতুন বড় কবিতা'।

          বিভিন্ন মতবাদের মধ্য দিয়ে জাপানি কবিতা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠতে থাকে। কাব্যিক উপমা, উৎপ্রেক্ষা পরিহার করে সহজ সরল গদ্য কবিতা লেখা শুরু হয়।

          বর্তমানে সেখানে ' শোয়া' যুগ ( ১৯২৬- ২০২০) চলছে। ইয়োরোপীয় ডাডা-ইজম, চীন-রাশিয়ার সর্বহারাবাদ, ফরাসী দেশের বিপ্লববাদ, সুকুমার ও ধ্রুপদী সাহিত্যের মেলবন্ধনে নতুর ধারার লেখার লেখালেখি চলছে সেখানে। এখন সেখানে হাইকু বা তানকা লেখা হয় না বললেই চলে। ওদের পরিত্যক্ত জিনিষ নিয়ে আমরা বাংলা ভাষায় গর্বের সঙ্গে চর্চা করে চলেছি। সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ। প্রায় ষোল শতাব্দী ব্যাপী জাপানী কবিতার দীর্ঘ ইতিহাসের সংক্ষিত রূপরেখা হলো প্রায় এইরকম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !