সবুজ দ্বীপ আন্দামান (দ্বিতীয় পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

দ্বিতীয় পর্ব


          আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পূর্বকথা: ভ্রমণ পিপাসুরা জাহাজ বা বিমান যেভাবেই আন্দামানে আসেন তাঁরা দেখেন রাশি রাশি সবুজে ঢাকা দ্বীপ সমূহ ও তার চোখ জুড়ানো রূপ। সমুদ্রের আদিগন্ত নীল জলরাশি, সমুদ্রের খাঁড়ি সমূহে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, নিবিড় অরণ্যানী, প্রশস্ত বালুকাবেলায় সমুদ্রের ঢেউয়ের চুম্বন, সমুদ্রতটে বালি হাঁসের দল - সবকিছু মিলে এক আশ্চর্য মায়া মুগ্ধকারী মোহিনী রূপ। দ্বীপগুলির তট লাগোয়া মহুয়া গাছের উন্নত শির, লাল পাতায় আচ্ছন্ন পেঁমা গাছ দ্বীপগুলিকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করেছে। এত রূপ তার তবুও বঙ্গোপসাগরের বুকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জকে অতীতকাল থেকে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেছেন। বিদেশী ভ্রমণকারীরা কেউ বলেছেন সৌভাগ্যের দ্বীপ, কেউ বলেছেন দ্বীপের গভীরে স্বর্ণখনি আছে, আবার কেউবা বলেছেন কুখ্যাত জংলী, উলঙ্গ মানুষের দ্বীপ। ভারতবাসীর কাছে দীর্ঘ প্রায় দু'শ বৎসর যাবৎ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ দ্বীপান্তর এবং তার সমুদ্র কালাপানি বলে চিহ্নিত ছিল। হাজার হাজার মাইল দূরে ভারত ভূমির মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, জঙ্গল বা তীরভূমি থেকে ধেয়ে আসা নেগ্রিটো মানুষদের বিষাক্ত তীর, অশান্ত সমুদ্র - দ্বীপপুঞ্জকে এক কুখ্যাত, বিভীষিকার দ্বীপ বলে চিহ্নিত করেছিল।     

          আন্দামানের অতীত ইতিহাস: আন্দামান নামটি অনুমান করা হয় হনুমান থেকে উদ্ভূত। মালয় উপদ্বীপে হনুমানের নাম হন্দুমান এবং হন্দুমান থেকে অপভ্রংশ হয়ে আন্দামান নামের উৎপত্তি। নিকোবর নামটি দক্ষিণ ভারতীয় নাক্কাভরম থেকে উদ্ভূত। নাকাভরম কথাটির অর্থ উলঙ্গ মানুষের দেশ। নাক্কাভরম কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায় ১০৫০ খ্রিস্টাব্দের তাঞ্জোরের শিলালিপি থেকে। ১০১৪ থেকে ১০৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতের চোলা বা চালুক্য রাজ বংশের রাজা রাজেন্দ্রর অধিকারে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ মারাঠাদের অধিকারে আসে। মারাঠা নৌবহরের অ্যাডমিরাল কানোজী আংরে পর্তুগিজ, ব্রিটিশ এবং ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে একটি নৌঘাঁটি স্থাপন করে ব্রিটিশ, পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজদের জাহাজগুলি ধ্বংস করে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। ১৭২৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে ব্রিটিশরা অধিকার করে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হওয়াতে দ্বীপপুঞ্জের অধিকার হস্তগত করার জন্য বিভিন্ন বিদেশী শক্তি বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চৈনিক পর্যটক ঝাও রুগুয়া তার ঝু-ফান-ঝি বইয়ে উল্লেখ করেছেন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কথা। সুমাত্রা থেকে সিংহল পর্যন্ত জল পথে যাবার সময় এই অঞ্চলে প্রতিকূল বাতাসের ফলে জাহাজগুলি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের দিকে ধাবিত হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে আন্দামানকে 'আন্দামান শান' বলে অভিহিত করেছেন চৈনিক পরিব্রাজক ঝেং হি তার সমুদ্রযাত্রার বিবরণীতে। আন্দামানের সৃষ্টি সংস্কৃতি এবং মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার থেকে অনুমান করা হয় আজ থেকে ৬০ হাজার বৎসর পূর্বে মধ্য প্রস্তর যুগের এখানে আদিম আন্দামানী জনগণ বিচ্ছিন্ন ভাবে বসবাস করত। পূর্বেই উল্লেখ করেছে ব্রিটিশ শাসকরা ১৭৮৯ সালে এখানে প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করে। ১৮২৪ সালে প্রথম ব্রহ্মদেশ যুদ্ধের সময় আন্দামানের পোর্ট কর্ণওয়ালিশ থেকে জাহাজগুলি ব্রহ্মদেশ অভিমুখে রওনা হয়। ১৮৩০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে জলদস্যুদের আক্রমণে যে জাহাজগুলি ধ্বংস হয়েছিল তার নাবিকেরা সাঁতার দিয়ে তটভূমির দিকে অগ্রসর কালে আদিম নেগ্রিটো অধিবাসীদের দ্বারা তীর বিদ্ধ হয় অথবা যারা কোনোক্রমে তটভূমির ভিতরে প্রাণের আশায় প্রবেশ করেছিল তারা আদিম জনজাতি দের দ্বারা নিহত হয়। এরপরে বিভীষিকাময় এই দ্বীপের নাম হয় নরখাদক দ্বীপ। ১৮৪৪ সালে 'রুণিমেড' এবং 'ব্রাইটন' নামের দুটি জাহাজ ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে নিমজ্জিত হয় এবং তার নাবিকদেরও একই রূপ গতি হয়। এই সমস্ত কারণে ব্রিটিশরা এখানে উপস্থাপনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে নেগ্রিটো আদিম জনজাতিদের সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু আন্দামানের ভৌগোলিক অবস্থান প্রাচীনকাল থেকে জলপথে যাতায়াতকারী নাবিকদের জানা ছিল। দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রিক ভূতাত্ত্বিক ও গণিতবিদ টলেমির লেখায় নেগ্রিটো জংলি, উলঙ্গ মানুষদের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে ভারতবর্ষের এই দ্বীপমানবেরা উলঙ্গ ও নরখাদক। সপ্তম শতাব্দীর চীনা পরিব্রাজক আই সিন-এর বর্ণনায় আন্দামানকে 'আন্দাবন' বলে উল্লেখ হয়েছে এবং নিকোবরের উল্লেখ হয়েছে 'আইসল্যান্ড অফ নেকেড পিপল্' বলে।  নবম শতাব্দীতে আরব পরিব্রাজক আবু জাঈদ হোসেন ও সলোমণের লেখাতে এই দ্বীপের উলঙ্গ ও নরখাদক মানুষের উল্লেখ আছে। এছাড়াও দ্বাদশ শতাব্দীতে ভেনিস পর্যটক মার্কোপোলো তার চীনদেশ যাত্রাপথে এই দ্বীপের কথা এবং এখানকার উলঙ্গ নরখাদক মানুষদের কথা উল্লেখ করেছেন। আরবীয় পরিব্রাজক নেজাবুলাসের বর্ণনায় উল্লেখ আছে 'আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদিম জনজাতি মানুষেরা মানুষের কাঁচা মাংস খায় এবং তাদের গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, কোঁকড়ানো চুল, চোখগুলি ভয়াল, লম্বা পা এবং তারা উলঙ্গ থাকে। বিদেশিদের দেখামাত্র তারা আক্রমণ করে'। আদিম জনজাতির মানুষদের সম্পর্কে বিভিন্ন কাল্পনিক ভয়াবহ রূপের বর্ণনা বিভিন্ন মানুষজন দিয়েছেন।    

          আন্দামানে মানুষের পদসঞ্চার: মনোবিজ্ঞানী ও গবেষকেরা বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় আদিম মানুষদের আদি পরিচয় বিশ্লেষণ করেছেন, যদিও সে খুবই কঠিন কাজ। জারোয়াদের আদি পরিচয়ের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আরো তিনটি নেগ্রিটো আদিম জনজাতির উল্লেখ করা প্রয়োজন। এরা হ'ল -  গ্রেট আন্দামানীজ, ওঙ্গি ও সেন্টিনেলিজ। গ্রেট আন্দামানিজেরা আজ থেকে প্রায় ১৬০ বৎসর পূর্বে সভ্য জগতের সংস্পর্শে আসে, ওঙ্গিরা ১১০ বছর আগে এবং জারোয়ারা মাত্র পঁচিশ বৎসর আগে সভ্য জগতের সংস্পর্শে আসে। সেন্টিনেলিজেরা এখনও পর্যন্ত সভ্য জগতের সংস্পর্শে আসে নি। আন্দামানের উত্তরে সেন্টিনেলিজ দ্বীপে তারা সভ্যজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জন্ম অনেক বিশেষজ্ঞের মতে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ফলে। আবার আধুনিক মানুষের বিবর্তনবাদের নীতি অনুযায়ী প্রকাশিত 'Out of Africa Theory'তে বলা হয়েছে আদিম মানব আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে পায়ে হেঁটে পূর্ব উপকূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে কয়েক হাজার বৎসর পরে এশিয়া মহাদেশে এসে পৌঁছায় এবং আজ থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার বৎসর পূর্বে তারা আন্দামানে এসে পৌঁছায়। 'Out of Africa Theory'-এর বিভিন্ন সংস্করণে আদিম জনজাতিদের আন্দামানে প্রবেশ সম্বন্ধে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে কোন একসময়ে ব্রম্ভদেশের আরাকান পর্বতমালা, মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে আন্দামান যুক্ত ছিল পরে জলোচ্ছ্বাসের ফলে ভূমিখন্ডের অনেকাংশ জলের তলায় চলে যায় এবং যে অংশ জলের উপরে থাকে তা বর্তমানে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। সর্বশেষ তুষার যুগের শেষে আজ থেকে ৪০ হাজার বৎসর পূর্বে সমুদ্রের জলস্তর ১০০ থেকে ১২০ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই জলোচ্ছ্বাসের ফলে মূল ভূখন্ড থেকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে 'গন্ডোয়ানা' মহাদেশ ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়ার পরেও বহু যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত ৪০ হাজার বৎসর পূর্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ থেকে ১২০ ফুট কম থাকায় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ মালয় উপদ্বীপ হয়ে ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। ভূপৃষ্ঠের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত আদিম মানবের দল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে আসার পরে মালয় বা ইন্দোনেশিয়া হয়ে পদব্রজে ৪০ হাজার বৎসর পূর্বে আন্দামানে প্রবেশ করেছিল। আবার অনেকের মতে ব্রহ্মদেশ হয়ে তারা আন্দামানে প্রবেশ করে। পরবর্তীকালে সমুদ্রের জলোচ্ছাসের ফলে সেই পথ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে যায়।

          ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !