সবুজ দ্বীপ আন্দামান (তৃতীয় পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তৃতীয় পর্ব


          খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ সিপ্রিয়ানির মতে, আন্দামানের নেগ্রিটো মানুষেরা সুমাত্রা থেকে নিকোবর হয়ে এসেছে, কিন্তু গবেষকদের মতে, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে নেগ্রিটো মানুষদের অতীতে অবস্থান সম্পর্কে কোনো প্রমাণ নেই। সিপ্রিয়ানি দাবি করেন নেগ্রিটোরা প্রথমে লিটিল আন্দামানে আসে। নেগ্রিটো জারোয়া ওঙ্গি এবং সেন্টিনেলিজেরা একসঙ্গে লিটল্ আন্দামানে বসবাস করত। পরবর্তীকালে খাদ্য সংকট ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য জারোয়া ও সেন্টিনেলিজেরা ডিঙি করে যথাক্রমে আন্দামান দ্বীপ সেন্টিনেলিজ দ্বীপে চলে যায়। সিপ্রিয়ানি ঝড়ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সামুদ্রিক আবহাওয়াকে জারোয়া ও সেন্টিনেলিজদের লিটল আন্দামান থেকে গ্রেট আন্দামান ও নর্থ সেন্টিনেলিজ দ্বীপে স্থানান্তরের সম্ভাব্য কারণ হিসাবে ব্যক্ত করেন। তিনি আরো বলেন জারোয়া ও সেন্টিনেলিজ দুটি নেগ্রিটো সম্প্রদায়ই ডিঙি করে সমুদ্রে শিকার করার সময় ঐরূপ দুর্ঘটনায় পড়ে। জারোয়াদের আসল নাম অঙ্গ। লিটল আন্দামানের ওঙ্গি (অঙ্গী) দের নামের কাছাকাছি। ওঙ্গি ও জারোয়াদের ভাষার মধ্যে বহু মিল আছে। 'তুমি' বাংলা কথাটি জারোয়ারা বলে 'নি', ওঙ্গিরাও বলে 'নি'। যেমন আমি বাংলা কথাটি জারোয়ারা বলে 'মি', ওঙ্গিরাও বলে 'মি'। বাংলায় 'ডেকচি' কথাটি জারোয়ারা বলে 'বুচু', ওঙ্গিরাও বলে 'বুচু' ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে আরও একটি জিনিস প্রশ্নের মুখে এসেছে। জারোয়ারা কি কাঠের বা বাঁশের ভেলায় লিটল আন্দামান থেকে গ্রেট আন্দামানে এসেছিল না সিপ্রিয়ানির মতবাদ অনুযায়ী ডিঙিতে এসেছিল। কারণ জারোয়ারা ডিঙির ব্যবহার জানত না এবং অতীতে ডিঙির ব্যবহার সম্পর্কিত কোন চিহ্ন বা প্রমাণ জারোয়া এলাকায় পাওয়া যায়নি।

          অনেক নৃতত্ত্ববিদ বা মনোবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, নেগ্রিটো মানুষেরা প্রাচীনকালে দক্ষিণ চীন এলাকা থেকে দক্ষিণ এলাকার দিকে যাযাবর জীবন যাপন করে বেড়াতে থাকে। ডঃ রেডক্লিফ ব্রাউন ও ডঃ পি দত্ত দাবি করেন নেগ্রিটো মানুষেরা ফিলিপাইনস থেকে সেলেবস ও বোর্নিও হয়ে মালয় উপদ্বীপে পৌঁছায় এবং পরে নিম্ন বার্মা এলাকায় আসে। তাঁরা আরো দাবি করেন অতীতে নেগ্রিটো মানুষেরা নিম্ন বার্মা এলাকার মরগুই দ্বীপপুঞ্জে অবস্থান করতেন। গবেষকেরা নেগ্রিটোদের ওই এলাকায় অবস্থান সম্পর্কিত প্রমাণ আবিষ্কার করেছেন। মতবাদ অনুযায়ী, নেগ্রিটোরা নিম্ন বার্মা এলাকার মরগুই দ্বীপপুঞ্জ থেকে ডিঙির সাহায্যে সমুদ্রপথে আন্দামানে এসেছে। সম্ভবতঃ শিকারের সময়ে প্রতিকূল সামুদ্রিক পরিবেশ তাদের অনিচ্ছাকৃত অভিবাসনকে কার্যকর করে। তাই আমাদের স্বীকার করতেই হয় 'Indo-european migration theory' অনুযায়ী আফ্রিকা থেকে আগত নেগ্রিটোরাই আজকের আন্দামানের আদিম জনজাতি জারোয়া, গ্রেট আন্দামানিজ, সেন্টিনেলিজ ও ওঙ্গি। আন্দামানের আদিম জনজাতি জারোয়া ও আরও তিনটি আদিম জনজাতিকে আজও প্রস্তর যুগের মানুষ বলা হয়, কিন্তু তাদের কাছে কোন পাথরে খোদাই ছবি বা নথি নেই। পাওয়া গেলে আদি পরিচয় আবিষ্কার করা সহজ হত।

          D.N.A. পরীক্ষা আদি পরিচয় আবিষ্কারে সহযোগিতা করেছে। এরা যে আফ্রিকা থেকে এসেছে তা পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক রেডক্লিফ ব্রাউন ১৯০৭ সালে গ্রেট আন্দামানিজদের মাথার চুল নিয়ে প্রমাণ করেছেন তারা আফ্রিকান নেগ্রিটো পিগমি গোষ্ঠীর সরাসরি বংশধর। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে জারোয়াদের সঙ্গে আফ্রিকার বুশম্যানদের সম্পর্ক আছে। তারা এই দ্বীপের প্রস্তর যুগের বাসিন্দা। হাজার হাজার বৎসর ধরে তাদের বাসস্থান এই দ্বীপভূমি। বর্তমানে জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের পরে আদিম জনজাতি জারোয়া ও আন্দামানের আরও তিনটি নেগ্রিটো আদিম জনজাতির আদি পরিচয় আবিষ্কার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

          পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এক লক্ষ মানুষের জিনগত নমুনা সংগ্রহের পরে ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে 'ওয়াই' ক্রোমোজোম বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয় আদি মানবেরা মধ্য আফ্রিকায় বাস করত। প্রায় এক লক্ষ বৎসর আগে আদি মানবের বংশধরেরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। জেনোগ্রাফিক প্রোজেক্ট দলের নেতা স্পেন্সার ওয়েলের মতে কম করে ৫০ হাজার বছর আগে আদি মানবের সন্তান দল আন্দামান দ্বীপে এসেছিল। স্পেন্সার ওয়েল ও তার সহযোগীরা আদি মানবের সন্তানদের যাত্রাপথ ও সময়কাল নির্ণয় করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

          গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিনসেন্ট ম্যাকাউলে ও তাঁর সহযোগীরা আবার আদি মানবের সন্তান দলের আফ্রিকা থেকে এশিয়া মহাদেশে যাত্রার বাৎসরিক গতিবেগ নির্ণয় করেছেন যা তাদের মতে বাৎসরিক ০.৪ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটার। জেনোগ্রাফিক প্রোজেক্ট দলের নেতা স্পেন্সার ওয়েলের মতে আদি গোষ্ঠী আফ্রিকা থেকে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল অতিক্রম করে দক্ষিণ বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আসে। তাদের এই অভিযাত্রা শুরু হয় এক লক্ষ বছর আগে। তার কুড়ি হাজার বৎসর পরে দ্বিতীয় দল যাত্রা করে। তাদের চাপে প্রথম দলের বংশধরেরা স্থানচ্যুত হয়। দ্বিতীয় দলটি হিন্দুকুশ পার্বত্য অঞ্চল, পাঞ্জাবের সমতল অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য দ্বিতীয় দলটির পরে আরো কয়েকটি দল পরবর্তীকালে আফ্রিকা থেকে এশিয়া যাত্রা করে।

          ভারতের হায়দ্রাবাদে অবস্থিত 'দি সেন্টার ফর সেলুলার এন্ড মলিকিউলার বায়োলজি' গবেষণাগারের গবেষকেরা খুব সম্প্রতি মাইট্রোকনড্রিয়াল ডিএনএ পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছেন আদি মানবের সন্তান দল পূর্ব আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করে লোহিত সাগরীয় অঞ্চল হয়ে পরিশেষে ভারতের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছায় এবং সেখান থেকে দক্ষিণ পূর্ব উপকূল হয়ে আন্দামানের দিকে আসে। এই সংস্থার ডিরেক্টর ডঃ লালাজি সিংয়ের মতে আন্দামানের চার নেগ্রিটো আদিম জনজাতি আফ্রিকা থেকে আগত ও আদি মানবের সরাসরি বংশধর। তাদের পূর্বপুরুষেরা দেড় লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় বাস করত। এই গবেষকদের মতে, বঙ্গোপসাগরের বুকে ভেসে থাকা দ্বীপমালায় নিকোবরীদের পূর্বপুরুষেরা ১৮ হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠী থেকে এসেছে। তারা আরো বলেছেন আদি মানবের সন্তান দল আফ্রিকা থেকে যাত্রা করে নীলনদ অতিক্রম করে সিনাই উপদ্বীপকে পিছনে ফেলে আরো উত্তরে গিয়ে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করে। সব গবেষণার মূল কথা একটাই আন্দামানের আদিম জনজাতি জারোয়া ও আরও তিনটি নেগ্রিটো আদিম জনজাতি আফ্রিকা থেকে আগত।

          বর্তমানে আমরা যখন আন্দামানের নেগ্রিটো মানুষদের বিতর্কিত আদি পরিচয় সম্পর্কিত বিষয়ের শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করছি তখনই আবার কিছু নতুন মতবাদ, চিন্তা-ভাবনা আকৃষ্ট করে। বিশেষজ্ঞ ও মানব বিজ্ঞানীরা আজও আন্দামানের নেগ্রিটোদের আদি পরিচয় বিষয়ে বিভিন্ন মত ও ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন।

          ২০০৯ সালে ভারতের এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ভি. এস. সহায় বলেছেন, যমজ দ্বীপগুলি যেমন মালয়েশিয়া-ফিলিপাইন্স, আন্দামান ও নিকোবর, পাপুয়া ও নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া ও তাসমানিয়া এমনই এলাকা যেখানে মানবজাতির বিবর্তন হয়ে সেখান থেকে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিশিষ্ট জার্মান জীববিজ্ঞানী আর্নেস্ট হেকল মতবাদ প্রকাশ করে বলেছেন আন্দামানের চার নেগ্রিটো জনজাতি যথা গ্রেট আন্দামানিজ, ওঙ্গি, জারোয়া ও সেন্টিনেলিজদের দৈহিক গঠন দেখে প্রমাণ হয় মানব জাতির বিবর্তন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল থেকে হয়েছে।

ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !