সবুজ দ্বীপ আন্দামান (চতুর্থ পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

চতুর্থ পর্ব

          আন্দামানের জারোয়া ও সেন্টিনেলিজ যারা এখনো সত্যিকারে প্রস্তর যুগের মানুষ বিশেষ করে সেন্টিনেলিজ দের আধুনিক জগতের জীবনযাত্রা স্পর্শ করেনি, বহির্জগতের রক্তের মিশ্রণ বা Racial mixture হয়নি। সর্বপ্রথম মানব সংস্কৃতির চিহ্ন আন্দামান ও দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপগুলিতে, এমনকি তাসমানিয়াতেও পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে অনেক আদিম জনজাতি বা প্রাচীন জাতি অবলুপ্ত হয়েছে বা অবলুপ্তির পথে গেছে। গবেষণায় প্রাপ্ত আরো বিষয়বস্তুকে ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞগণ দাবি করেন যে ডারউইনের বিবর্তনবাদের এক হারানো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। সেকালের মতে বিবর্তনের পথে মানুষ ও বানরের মাঝে 'Phecanthropus' জাতীয় এপ ম্যান ছিল। তিনি বলেছেন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানব জাতির দেহের ঘন আচ্ছাদিত চুল বিনষ্ট হয়ে যায়। এপম্যানেরা সেই সব অঞ্চলে বাস করত। এপম্যানদের প্রজাতি গোরিলা ও শিম্পাঞ্জিকে আফ্রিকায়, ওরাংওটাং ও গিব্বনদের মালয়েশিয়ায় দেখা যায়।

          এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ভি. এস. সহায় গবেষণা করে আরও দাবি করেছেন যখন সেন্টিনেলিজ ও জারোয়াদের দৈহিক গঠন পরীক্ষা করা হয় দেখা যায় তাদের চামড়া লোমহীন ও মসৃণ, যা প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য হয়েছে। এইসব প্রমাণ করে আন্দামান ও নিকোবর এলাকার আদিম মানুষেরা আদি মানবের বংশধর। মানবজাতির বিবর্তনের পথ ধরে লক্ষ বছর ধরে তারা এখানেই আছেন এবং তারা কিন্তু আফ্রিকা থেকে আসেনি।

          মানব বিজ্ঞানীরা 'কালচারাল এনথ্রপলজি' অনুসারে আবিষ্কার করেছেন আন্দামানের চার নেগ্রিটো আদিম জনজাতির আচার-আচরণের সঙ্গে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের এইটা (Aeta) এবং মালয় উপদ্বীপের সেমাং উপজাতির আচার-আচরণের অনেক মিল আছে। এইভাবে বিভিন্ন মতবাদের জালে জড়িয়ে আছে আন্দামানের আদিম জনজাতির আগমনের এবং তাদের বিবর্তনের ব্যাপার।

          প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় সম্পর্কিত মতবাদ অনুযায়ী আন্দামান দ্বীপের বিভিন্ন অংশে নেগ্রিটো আদিম জনজাতি মানুষদের ব্যবহৃত 'Kitchen midden heap' আছে যা স্থানীয় মানুষের ভাষায় C.P.Tigri কে খনন করে আদিম জনজাতির অতীত ইতিহাস জানা গেছে। জানা গেছে তাদের অবস্থান সম্পর্কিত বিষয়কে। এক শতাব্দীর আগে আজকের পোর্ট ব্লেয়ারের কাছাকাছি 'Bamboo flat' নামে এক জায়গায় আদিম জনজাতি নেগ্রিটো মানুষদের ব্যবহৃত সি. পি. টিগ্রী খনন করে গবেষণা করেন এল ল্যাপিক। 1952 সালে এনথ্রোপলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার শ্রী বি,কে, চ্যাটার্জী আন্দামানের দ্বীপের একটি টিগরি খনন করে গবেষণা করেন। কাছাকাছি সময়ে নৃতাত্ত্বিক গবেষক পি. সি. দত্ত আন্দামানের এক টিগরি নিয়ে গবেষণা করেন। এই টিগরি থেকে শেল, রান্নার মাটির বাসনের ভাঙ্গা অংশ, পশুর হাড় এবং পুরাতন অস্ত্র (যেগুলি হাড়, শেল ও পাথর থেকে বানানো) পাওয়া গেছে। টিগরি গুলিতে এই সমস্ত জিনিস স্তরে স্তরে সাজানো অবস্থায় ছিল। সবচেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া গেছে মধ্য আন্দামানের 'বিহাইভ' দ্বীপের টিগরি থেকে। এইখানে যে সমস্ত পাথরের অস্ত্র-গুলি পাওয়া গেছে তার সাথে ইন্দনেশিয়া অঞ্চলের পাথরের অস্ত্রের মিল আছে। এইগুলি খনন করে যে সমস্ত জন্তুর হাড় পাওয়া গেছে তাদের প্রজাতি এখনো বেঁচে আছে বলে অনুমান করা হয়। অনেকের মতে তাই এইগুলি অতি দূর অতীতের নয় বরং কাছাকাছি সময়ের। মধ্য প্রস্তর যুগের সাংস্কৃতিক জীবনে আন্দামানের আদিম জনজাতি মাটির বাসনপত্র ব্যবহার করত। এই সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী গ্রেট আন্দামানিজেরা আজ আর মাটির বাসনপত্র ব্যবহার করে না। এইরকম বাসনের ব্যবহার সমসাময়িক যুগে সেলেবস - এর 'টোয়ালে' মানুষদের মধ্যে ছিল। সবকিছু ব্যাখ্যা করে মানব বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই সংস্কৃতি খ্রিস্টের জন্মের কিছু আগে আন্দামানের আদিম জনগণের কাছে আসে। প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য তাই প্রমাণ করে আদিম জনজাতি জারোয়া বা অন্যান্য তিনটি শ্রেণীর মানবগোষ্ঠী অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে ছিল।

          আদি পরিচয় দিতে গিয়ে যাদের আমরা জারোয়া বলছি আসলে তাদের পরিচয় জারোয়া হিসাবে নয়, জারোয়া শব্দটি ব্যবহার করে গ্রেট আন্দামানিজেরা। তারা তাদের প্রতিবেশীকে এইভাবে ডাকত। জারোয়া কথার অর্থ 'অ্যাটাকিং পিপল' বা মারমুখী মানুষ। গ্রেট আন্দামানের সুরে সুর মিলিয়ে অতীতকাল থেকে এই আদিম জনজাতিকে আমরা জারোয়া বা মারমুখী মানুষ বলে আসছি। আসলে তাদের নাম অঙ্গ। আর অঙ্গ - রা আমাদের বলে ইনেন।

          এই অঙ্গ বা জারোয়ারা তিন দলে বিভক্ত। এরা থাকে পশ্চিম সমুদ্র তটের সংলগ্ন অরণ্যে। মধ্য আন্দামানের অঙ্গ - দের নাম 'তানমাড অঙ্গ', দক্ষিণ আন্দামানের মিডিল স্ট্রেট ও আর, কে,নালা সংলগ্ন অঙ্গ - রা 'থিডং অঙ্গ' বলে পরিচিত এবং সবশেষে দক্ষিণ আন্দামানের তীরুর জারোয়া বা অঙ্গ - রা 'ভইয়াবা অঙ্গ' বলে পরিচিত। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল 'আকা' যাদের নাম ছিল আজ তাদের আমরা গ্রেট আন্দামানিজ বলে ডাকি। গ্রেট আন্দামানিজদের সুরে সুর মিলিয়ে অতীতে ওঙ্গিদের আমরা জারোয়া বলে ডেকেছি। একমাত্র সেন্টিনেলিজদের পরিচয় এখনও সম্পূর্ণভাবে পাওয়া যায়নি যেহেতু তারা সেন্টিনেল দ্বীপে থাকে এবং সাধারণের কাছে একদম মুখোমুখি হয় না। একটা কথা অত্যন্ত সত্য যে সভ্য জগতের সংস্পর্শে এসে এই আদিন জনজাতিদের মৌলিক অস্তিত্ব বিঘ্নিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সভ্য মানুষের নৈতিক ও আবশ্যিক কর্তব্য এই যে প্রাচীন জনজাতির মানুষদের আচার - ব্যবহার সমস্ত কিছু বজায় রেখে তারা যাতে দীর্ঘজীবী হয় এবং বংশবিস্তার করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।

ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !