লেখিকা: রত্না দত্ত
ছেলেবেলা থেকে গান শিখলেও গানের ক্ষেত্রে তেমন কোনও উন্নতির লক্ষণ ছিল না মেয়েটির মধ্যে। অথচ গানের পরিবারেই তার জন্ম। বাবা বাড়িতে গান শেখাতেন ছাত্রছাত্রীদের। একদিন গান শেখানোর সময় হঠাৎ করে কোনো কাজ এসে পড়ায় মেয়েটির বাবাকে বাড়ির বাইরে যেতে হল। এক ছাত্রকে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন রেওয়াজ যেন ঠিকঠাক চলে। খানিক পরেই তিনি কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবেন। কিছুক্ষণ পরে বাবা যখন বাড়ি ফিরলেন দেখলেন মেয়েটি ওই ছাত্রটির রাগ শুধরে দিচ্ছেন।এই মেয়েটি আর কেউ নন সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। আর তাঁর বাবার নাম দীননাথ মঙ্গেশকর।
খুব বেশিদিন বাঁচেননি দীননাথ মঙ্গেশকর। লতার যখন ১৩ বছর বয়স তখন তিনি প্রয়াত হন। বড় সংসারের বোঝা এসে পড়ে লতার ছোট্ট ঘাড়ে। সেই সময়েই পাশে এসে দাঁড়ালেন পারিবারিক বন্ধু তথা নবযুগ চিত্রপট সিনেমার মালিক বিনায়ক দামোদর কর্ণাটকী। লতাকে তিনি গান আর অভিনয় শিখিয়ে সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করলেন মারাঠি সিনেমাতে। কিন্তু সিনেমায় অভিনয় করতে খুব একটা ভালো লাগত না লতার। কিন্তু ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই, গোটা পরিবারের দায়িত্ব যে তাঁরই কাঁধে।
মঙ্গেশকর পরিবারের বন্ধু বিনায়ক দামোদর কর্ণাটকী, বাবা দীননাথের পর লতার সঙ্গীতগুরু ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর লতার সঙ্গীতগুরু হন গুলাম হায়দার। নিজের ৮৪ তম জন্মদিনে লতাজী বলেছিলেন, তাঁর জীবনে গডফাদার ছিলেন গুলাম হায়দার।
মাত্র তিন বছর বয়সে তৎকালীন বম্বে এবং অধুনা মুম্বাইতে পা রেখেছিলেন এই সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী।এখানকারই একটি স্কুলে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু তাঁর স্কুল জীবন ছিল মাত্র দুদিনের। কারণ প্রথম দিন স্কুল যাওয়ায় এক শিক্ষক তাঁকে হাতে ধরে লেখা শিখিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দিন লতা বোন আশা ভোঁসলেকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যান। যা দেখে রেগে যান ওই শিক্ষক। প্রচণ্ড বকাবকি করেন লতাকে। ব্যাস খারাপ লাগে লতার। অভিমান হয় প্রচণ্ড। তৃতীয় দিন থেকে আর স্কুলমুখো হননা তিনি। বাড়িতে থেকেই নিজের পড়াশোনা চালান।
নিজের কয়েক দশক ধরে চলা সঙ্গীত জীবনে নিজের গাওয়া গান শুনতেন না লতাজী।কারণ নিজের গান শুনলে নাকি তাঁর মন খারাপ হবে।মনে হবে গানটি ঠিকমত গাননি, অন্যভাবে গাওয়া যেত। সারাজীবনে কখনও স্টুডিওতে গিয়ে চেয়ারে বসে গান রেকর্ড করেননি এই সঙ্গীত শ্রী।তিনি মনে করতেন যে গান দাঁড়িয়েই গাইতে হয়।আর রেকর্ডিংয়ে গিয়ে কিছুই খেতেন না তিনি, শুধু কয়েক কাপ চা ছাড়া।
অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন নাট্যমঞ্চের পরিচিত মুখ। বাবার হাত ধরেই অনেক ছোট বয়সে নাটক, গানের সঙ্গে পরিচয়।দিদিমার কাছে লোকগানের তালিম নেওয়া শুরু সেই ছেলেবেলায়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে গান গেয়ে ২৫ টাকা রোজগার করেছিলেন লতা। তার পর তো স্বপ্নের উড়ান।
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববাসীর মন জয় করেছিল সুরেলা কণ্ঠ। এই মহান শিল্পীর জীবনের চলার পথ ২৫ টাকা দিয়ে শুরু হলেও তার অধ্যাবসায় ও নিষ্ঠা দিয়েই পরবর্তীতে তিনি হয়েছিলেন কোটি কোটি টাকার মালিক। এত অর্থের মালিক এত নাম এত খ্যাতি এত প্রতিপত্তির পরেও তিনি কিন্তু মাটির মানুষ ছিলেন। কারণ তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠলেও নিজের শিকড় তিনি কিন্তু ভুলে যাননি।অত্যন্ত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এই মহাগায়িকার ৯২ বছর বয়সে চলে যাওয়াটা ভারত তথা গোটা পৃথিবীর সংগীতের বড় ক্ষতি বলে মনে করছেন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞরা।
১৯৭৪ সালে সবচেয়ে বেশি গানের শিল্পী হিসেবে গিনেস বুকে স্থান পান লতা মঙ্গেশকর। ছবিতে লতার গান থাকা মানেই ছিল হলের বাইরে দর্শকদের লম্বা লাইন। লতার সুমধুর গলার আওয়াজ,সুর প্রাণ ঢেলে দিত গানে। প্রকৃতিও যেন জাদুকণ্ঠীর গানে বিভোর হয়ে যেত। তিনি একহাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন এবং তাঁর গাওয়া মোট গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। এছাড়া ভারতের ৩৬ টি আঞ্চলিক ভাষাতে ও বিদেশি ভাষায় গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ড তাঁরই ঝুলিতে।
এই প্রসঙ্গে স্বরচিত কয়েকটি লাইন:
ভারতবাসীর শতাব্দী লালিত গর্ব হল আজ অস্তমিত,
তবুও খর্ব হবেনা কোকিলকণ্ঠি লতা মঙ্গেশকরের সুরেলা ব্যাক্তিত্ব।
একে একে স্বর্ণযুগের সকল ব্যক্তিত্বই নিচ্ছে বিদায়,
মা সরস্বতীর মানসপুত্রী, তুমিও মায়ের সাথে নিলে চিরবিদায়।
আকাশে বাতাসে বাজছে যে আজ বড়ই বেদনার করুণ সুর,
সুর সম্রাজ্ঞীর মহাপ্রয়াণে বিশ্ববাসী বেদনাবিধূর ও শোকাতুর।
বীণাপানীর জাগ্রত প্রতিমূর্তি হে সুরের জাদুকরী,
নানাভাষায় নানাগানে কণ্ঠ দিয়েছিলে তুমি, সেই গান যে অমর ও হৃদয়হরণকারী।
আপামর ভারতবাসী, অখিল ব্রহ্মান্ডের তুমি আপনার জন,
তোমার কোকিল কণ্ঠের মিষ্টি সুরের জাদুতে ভাসিয়েছ সকলের প্রাণমন।
Please do not enter any spam link in the comment box.