সবুজ দ্বীপ আন্দামান (পঞ্চম পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

পঞ্চম পর্ব

          আদিম মানুষের খোঁজে আন্দামানের অরণ্যে সভ্য মানুষের পদসঞ্চার: আদিম মানবের সন্ধানে সবুজ দ্বীপের অরণ্যে ১৭৮৯ সালের ২৬শে ডিসেম্বর এক অসীম সাহসী ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট আর. এইচ. কোলব্রুক তার জাহাজ নিয়ে সমুদ্রের খাঁড়ি ধরে চলেছেন। হঠাৎ তার দৃষ্টি যেয়ে নিবদ্ধ হল দক্ষিণ আন্দামানের বর্তমানের পোর্টব্লেয়ার সন্নিহিত ডানডাস পয়েন্ট এলাকার সমুদ্রতটের একটি গাছের উপরে। তিনি জাহাজ থেকে দেখতে পেলেন সেই গাছ থেকে কালো কুচকুচে একজন উলঙ্গ মানুষ বানরের মতো লাফিয়ে গাছ থেকে নামল এবং তার কয়েকজন সঙ্গীকে তাদের ভাষায় ডাকলো। এদের মধ্যে একজন মহিলাও ছিলেন। তাদেরকে দেখে তিনি জাহাজকে সমুদ্রতটের নিকটে নোঙ্গর করলেন। নোঙ্গর করা জাহাজ থেকে কোলব্রুকের লোকেরা কয়েকটি নারকেল সমুদ্রতটে ছুঁড়ে দেওয়ার পরে দেখলেন সেই উলঙ্গ মানুষেরা নারকেলগুলি নিতে আসার জন্য দ্বিধাবোধ করছে, কারণ তারা একবার করে নারকেলগুলির সামনে আসছে পরক্ষনেই পিছিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে কোলব্রুক তার জাহাজটিকে একটু পিছনে নিয়ে গেলেন। জাহাজটি পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরেই একজন উলঙ্গ আদিম মানুষ নারকেলগুলি হাতে নিয়ে চিৎকার করতে করতে সঙ্গীদের নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল। সেই দিনেই কোলব্রুক দক্ষিণ আন্দামানের একই এলাকার অন্য এক সমুদ্রতটে অপর একজন আদিম মানুষের সরাসরি সংস্পর্শে আসেন। সেই আদিম মানুষের হাতে একটি ছুরি দেওয়ার পরে তিনি সেই আদিম মানুষের কাছ থেকে একটি তীর-ধনুক চেয়ে নেন। এছাড়াও সেই উলঙ্গ মানুষটির হাতে তিনি কয়েক প্যাকেট বিস্কুট দেন। এইভাবে আদিম মানুষ ও সভ্য জগতের মানুষের সাথে সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক বিনিময় হয়। সভ্য মানুষদের সাথে আদিম মানুষদের এইভাবে প্রথম দেখা, সংস্পর্শ, শুভেচ্ছা ও সৌহার্দ্যের বিনিময় হয়। ভালোবাসা ও ভাবের আদান প্রদান ছিল সেদিনের মূল কথা। এই আদি মানবেরা কিন্তু সভ্য জগতে ধরা দেওয়ার কথা ভাবেনি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা সভ্য জগতের সংস্পর্শে এসেছে। সোয়া দুশ বছর আগের সেদিনের সেই ঘটনাএকটা তীর-ধনুকের বিনিময়, একটা ছুরি ও কিছু বিস্কুটের আদান-প্রদান ছিল ভালোবাসা ও আন্তরিকতার দৃষ্টান্ত। দুই জগতের মানুষ সেদিন মনের মলিনতাকে অনেক দূরে রেখেছিল। কিন্তু বর্তমানে সভ্য জগতের মানুষ তাদের সাথে লজ্জাজনকভাবে বাণিজ্যিক বিনিময় স্থাপনের দ্বারা তাদের সরলতা ও অজ্ঞতার সুযোগে প্রতারণা করে চলেছে। ভাবার সময় এসেছে কম্পিউটার যুগের সভ্য সমাজ সত্যিই কি প্রস্তর যুগের মানুষদের থেকে অধিক সভ্য বলে দাবি করতে পারে? যে ঘটনাটি, আদিম মানুষের সাথে সভ্য জগতের মানুষের মধ্যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল সেই ঘটনাটি সংক্ষেপে বলছি।

          ১৯৯৬ সালের ১৫ই এপ্রিলে মধ্য আন্দামানের বাঙালি উপনিবেশ অধ্যুষিত গ্রাম কদমতলায় পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি বাস্তুহারা বিজয় বারুইয়ের গৃহসংলগ্ন নালার কাছে তার গৃহপালিত কুকুর বারবার চিৎকার করে যাচ্ছে এবং ফিরে আসছে। কুকুরের চিৎকারে গৃহকর্তা কৌতূহলবশতঃ সেখানে গিয়ে দেখলেন সামনের নালার মধ্যে এক আদিম জারোয়া তরুণ পড়ে আছে এবং করুণভাবে হাত তুলে সাহায্য প্রার্থনা করছে। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে কদমতলা গ্রামে আসার পর থেকেই যে কদমতলা গ্রামের অধিবাসীরা দুর্ধর্ষ জারোয়াদের ভয়ে ঘরের বাইরে বেরোত না সেই জারোয়াদের একজনকে এভাবে দেখে বিজয় বারুইয়ের বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি গ্রামবাসীদের ডেকে নিয়ে এসে সেই দৃশ্য দেখাতে গ্রামবাসীদের মধ্যে সহানুভূতির উদ্রেক হল। তারা দেখলেন চোদ্দ পনেরো বয়সের এক জারোয়া তরুণের দুর্ধর্ষ রূপের পরিবর্তে যন্ত্রণাক্লিষ্ট কাতর মুখ। তারা সামনে যেয়ে দেখলেন তার পায়ের দুটো হাড়ই ভেঙে গেছে। গ্রামবাসীদের মধ্যে একজন তামিল যুবক ছিলেন। তার গায়ের রং ঘন কালো দেখে সেই জারোয়া তরুন, হয়তো তাদের স্বজাতি ভেবে, তাকে কাছে ডাকার পরে সেই তামিল যুবকের হাত থেকে জারোয়া তরুণটি খাবার ও জল খেল। ঘটনাটির পশ্চাদপট এইরকম। ১৪ই এপ্রিল রাত্রিতে জারোয়ারা দলবেঁধে কদমতলা গ্রামে গিয়ে গৃহস্থদের কলা, নারকেল, কাঁঠাল ও গৃহস্থালি সামগ্রী চুরি করতে আসে। কলাবাগানে গাছকাটার আওয়াজে গৃহকর্তা বিজয় বারুই ঘরের বাইরে আলো জ্বালিয়ে চারিদিক নিরীক্ষণ করে দেখেন আলো জ্বালা মাত্র সব জারোয়ারা ভয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু এই তরুণ জারোয়া একটা গাছের শিকড়ের মধ্যে তার ডান পা ঢুকে যাওয়াতে দৌড়ে পালিয়ে যাবার সময় দুটো হাড় ভেঙে দু-টুকরো হয়ে যায়। ফলে সে ভাঙা পা নিয়ে পালাতে না পেরে সেই নালার মধ্যে যন্ত্রনা নিয়ে সারারাত পড়ে থাকে। পুলিশকে খবর দেওয়ার পরে তারা সেই তরুণ জারোয়া 'ইনমেই'কে কদমতলা গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে স্থির হয় তার পায়ের সুচিকিৎসার জন্য তাকে পোর্টব্লেয়ারে গোবিন্দ বল্লভ পন্থ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হবে। মধ্য আন্দামানের কদমতলা থেকে পোর্ট ব্লেয়ার পর্যন্ত আন্দামান ট্রাঙ্ক রোডের সমস্ত পুলিশ স্টেশন ও ওয়্যারলেস স্টেশনকে সচেতন করা হয়, কারন রাস্তার পাশের জঙ্গলে জারোয়াদের গতিবিধি আছে কিনা তা জানার জন্য। জারোয়াদের নজরে এলে তারা সেই গাড়িকে আক্রমণ করতে পারে এই ছিল প্রশাসনের আশঙ্কা। পোর্টব্লেয়ারে যাবার পরে হাসপাতালের তদানীন্তন শল্যচিকিৎসক ডাক্তার এন সদাশিবন সেই তরুণ জারোয়ার ডান পায়ের ভাঙ্গা হাড় ও ক্ষতের যথাযথ চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। সেখানে থাকতে থাকতে সেই তরুণ জারোয়া সকলের সাথে আদব-কায়দা ও ভঙ্গিমার মাধ্যমে ভাবের আদান প্রদান করতে থাকে। সুস্থ হয়ে যাবার পরে প্রশাসন তাকে তার অরন্যের কুটিরে গিয়ে ফেরত দিয়ে এসেছিল। দীর্ঘ ছয় মাস 'ইনমেই'-কে হারানোর পরে তার স্বজাতি জারোয়ারা ধরে নিয়েছিল সে মৃত অথবা সভ্য জগতের মানুষেরা তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু কুটিরে ফিরে আসার পরে তাঁর কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে তারা বিস্মিত হয়ে যায়। এই জারোয়া তরুণকে সুস্থ করে তোলার পরে জারোয়াদের মধ্যে এক পরিবর্তন দেখা গেল এবং তারা সভ্য জগতের মানুষদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে প্রয়াসী হল বা বলা যায় জারোয়াদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী সভ্যমানুষদের প্রয়াস সফল হলো।

          ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !