লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
ষষ্ঠ পর্ব
১৭৮৯ সাল থেকে ১৭৯৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশেরা আন্দামানে প্রথমে দক্ষিণ-পূর্ব বন্দরে এবং পরে উত্তর-পূর্ব বন্দরে কয়েদী উপনিবেশ গড়ার চেষ্টা করে কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য সাত বছর পরে ব্রিটিশেরা এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যায়। এই সময়ে আদি মানব জারোয়ারা ব্রিটিশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে। ব্রিটিশেরা লক্ষ্য করে পোর্ট ব্লেয়ার ও তার দক্ষিণের কিছু অংশের আদিম মানবেরা বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করছে কিন্তু বাকি অংশের মানুষেরা মারমুখী মনোভাবাপন্ন। ব্রিটিশেরা বুঝতে পারেনি যে তারা দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর আদিম জনজাতির সংস্পর্শে এসেছে। যারা সেদিন বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব দেখিয়েছিল তারা হল জারোয়া এবং যারা শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব দেখিয়েছিল তারা কিন্তু গ্রেট আন্দামানিজ। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এই পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যায়। ১৮৫৮ সালের পরে গ্রেট আন্দামানিজেরা ব্রিটিশের সাথে হাত মেলাতে বাধ্য হয়। কি এমন ঘটনা ঘটলো যে গ্রেট আন্দামানিজেরা, যারা পূর্বে শত্রুভাবাপন্ন ছিল তারা ব্রিটিশের সাথে হাত মেলাতে বাধ্য হল।
১৮১৮ সালে ব্রিটিশেরা আন্দামানে 'পেনাল সেটেলমেন্ট পলিসি' চালু করেছিল। এই আইনে বলা ছিল কোন পরিস্থিতিতেই আদিম মানুষের স্বার্থে যাতে আঘাত না লাগে সেবিষয়ে প্রশাসনের যেন সতর্ক দৃষ্টি থাকে। কিন্তু উপনিবেশ কর্তৃপক্ষ আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য আদিম জনজাতির চিরাচরিত বাসস্থান জঙ্গলের অংশগুলি কেটে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছিল। এই কারণে গ্রেট আন্দামানিজেরা (তদানীন্তন আকাবিয়া জনজাতি) আবহমানকাল থেকে তাদের অধিকারে থাকা অরণ্যে বহিরাগতদের উপস্থিতি কোন মতেই মেনে নিতে পারছিল না। তারা ব্রিটিশের কয়েদি উপনিবেশ স্থাপনের প্রচেষ্টাকে উৎখাত করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৮৫৯ সালে মে মাসে শতশত গ্রেট আন্দামানিজেরা তীর ধনুকে সজ্জিত হয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের কয়েদী উপনিবেশ ও উপনিবেশ কর্তৃপক্ষের বাসস্থান গুলি আক্রমণ করে। ইতিপূর্বে কয়েদী উপনিবেশ থেকে দুধনাথ তেওয়ারি নামে একজন কয়েদী এক বৎসর পূর্বে ব্যারাক থেকে পালিয়ে জঙ্গলে যেয়ে গ্রেট আন্দামানিজদের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। আকাবিরা জনজাতির উপনিবেশ আক্রমণের খবর জানতে পেরে দুধনাথ বিশ্বাসঘাতকতা করে উপনিবেশ কর্তৃপক্ষকে সেই খবর দেয় যার ফলে জনজাতির সশস্ত্র আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উপনিবেশ কর্তৃপক্ষ কামানের গোলা ও বন্দুকের গুলিতে শতশত গ্রেট আন্দামানিজদের নিহত করে। এর ফলে গ্রেট আন্দামানিজেরা পরাজয় বরণ করে। তাদের তীর-ধনুক কামান বন্দুকের গুলির কাছে নতি স্বীকার করে। এই যুদ্ধ 'এবারদিনের' যুদ্ধ নামে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়। সেদিন যদি দুধনাথ বিশ্বাসঘাতকতা না করতো তাহলে হয়তো ব্রিটিশের দ্বিতীয়বারের কয়েদি উপনিবেশ স্থাপনের প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে যেত এবং তাহলে সেলুলার জেলের মত কুখ্যাত জেলের সৃষ্টি হতো না। এরপরে আন্দামানের আদিম জনজাতির চিত্র ভিন্নমুখী হয়। গ্রেট আন্দামানিজেরা ব্রিটিশের বশ্যতা স্বীকার করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় কিন্তু যে জারোয়াদের সাথে লেফটেন্যান্ট কোলব্রুক ৭০ বৎসর আগে মিত্রতার বন্ধন স্থাপন করেছিলেন তারা ক্রমশ শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে।
১৮৮৬ সালে ওঙ্গি জনজাতির ব্রিটিশের বশ্যতা স্বীকার করে। ইতিমধ্যেই উপনিবেশ কর্তৃপক্ষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্য আদিম জনজাতিদের জন্য রস আইল্যান্ড দ্বীপে 'আন্দামান হোম' স্থাপন করে। ১৮৭৯ সাল থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে আন্দামানে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক এম, ভি, পোর্টম্যান জারোয়াদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। কোনমতেই জারোয়ারা সভ্য জগতের মানুষদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে রাজী হয়নি, উপরন্তু উপনিবেশ কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের তিক্ততা বাড়তে থাকে। উপনিবেশ কর্তৃপক্ষ মিত্রতা স্থাপনের উদ্দেশ্যে যখন জঙ্গলে অভিযান চালাতো সেই সময়ে তারা বশ্যতা স্বীকারকারী জনজাতি গ্রেট আন্দামানিজদের, কয়েদী উপনিবেশের কয়েদীদের ও শিকারি কুকুরদের নিয়ে যেত। কিন্তু এতে ফল হয়েছে বিপরীত। কারণ জারোয়াদের চিরশত্রু গ্রেট আন্দামানিজদের দেখে জারোয়ারা তাদের হত্যা করত অথবা তাদের কুটির গুলি ধ্বংস করত।
১৯৪২ সালে জাপান কর্তৃক আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ অধিকার করার পরে তারাও দমনমূলক অভিযান চালিয়ে জারোয়াদের কুটির গুলি জ্বালিয়ে দিত এবং তাদের বসতি এলাকায় নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে বেশকিছু জারোয়াকে হত্যা করে। ১৯৪৫ সালে জাপানের আত্মসমর্পণের করে পুনরায় আন্দামান ব্রিটিশের অধিকারে আসে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরেও জারোয়ারা বশ্যতা স্বীকার করেনি। ১৯৭০ সালে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড স্থাপন শুরু হওয়ার পরেও জারোয়ারা রাস্তা নির্মাণকারী শ্রমিক ও প্রশাসনের লোকেদের উপরে বহুবার আক্রমণ করেছে। এক শতাব্দীর কয়েদী উপনিবেশ এবং পরবর্তীকালে উদ্বাস্তু উপনিবেশের ফলে জারোয়ারা বিভিন্ন জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে বর্তমানে দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামানের পশ্চিম সমুদ্রতট সংলগ্ন ১০২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সীমাবদ্ধ। আন্দামানের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মধ্য আন্দামানের উত্তর দিগন্ত পর্যন্ত যে গভীর অরণ্য ছিল তাদের বাসভূমি, বর্তমানে সেখান থেকে তারা প্রায় বিতাড়িত হয়ে গেছে। অবশেষে ১৯৯৬ সালের পরে জারোয়ারা সভ্য জগতের মানুষদের সহৃদয় ব্যাবহারের কাছে আত্মসমর্পন করে। সে ঘটনার উল্লেখ পূর্বেই করেছি।
ক্রমশঃ
Please do not enter any spam link in the comment box.