লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
সপ্তম পর্ব
আন্দামানে আমাদের কয়েকদিন সেদিন ক্লান্তিতে বিকেলে কোথাও যাওয়া হলো না। পরের দিন সকালে হোটেল থেকে রাজীব গান্ধী নগরে স্টেট ব্যাংকের অবকাশ গৃহে স্থানান্তর করে দুপুরে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের টুরিস্ট অফিসে গিয়ে হ্যাভলক, নীল আইল্যান্ড, রঙ্গত, দিগলিপুরের পর্যটক আবাসগুলিতে থাকার ব্যবস্থা হল। এখানে এক বাঙালি ভদ্রলোক (কর্মচারী) আমাদের থাকার সব ব্যবস্থা করে দিলেন এবং তার কাছেই আন্দামানের পর্যটন স্থানগুলি সম্বন্ধে অবহিত হলাম। বিকেলে মেরিনা পার্ক দেখে ফিরে এলাম। এখনো পর্যন্ত সেলুলার জেল দেখা না হওয়াতে স্থির করলাম আগামীকাল সকালে সেলুলার জেল দেখতে আসবো। পরের দিন সকালে সাড়ে নটাতে সেলুলার জেলের প্রবেশপথে টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি সোমবার এবং জাতীয় ছুটির দিন বাদ দিয়ে প্রতিদিন সকাল নটা থেকে থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত এবং পুনরায় দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সেলুলার জেল দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। এছাড়াও সন্ধ্যা ছটা থেকে সাতটা পর্যন্ত এবং ৭-১৫ থেকে ৮-১৫ পর্যন্ত যথাক্রমে হিন্দি ও ইংরেজিতে আলো ও ধ্বনির সাহায্যে একটি প্রদর্শনী হয় যার সাহায্যে দর্শক সেলুলার জেলের অতীত ইতিহাস জানতে পারে। অতীতের কুখ্যাত জেল আজকের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সেলুলার জেলের ভিতরে প্রবেশ করার পূর্বে স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল অতীতের ইতিহাস - সেলুলার জেল স্থাপনের পশ্চাদপট, সেখানে বন্দীদের অমানুষিক পরিশ্রম ও অত্যাচারের দিনগুলির ইতিহাস একের পর এক।
ভারতের বাস্তিল: আন্দামানের সেলুলার জেল আন্দামানে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেল যেখানে দীর্ঘ প্রায় ৯৪ বৎসর যাবৎ ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীদের বিচারের নামে প্রহসন করে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ভারতমাতার অসংখ্য সন্তানকে ফাঁসির যূপকাষ্ঠে প্রাণ বলিদান দিতে হয়েছিল অথবা ইংরেজদের তিল তিল করে পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে। কয়েদী উপনিবেশ স্থাপন করার মূল উদ্দেশ্য ছিল সমুদ্র পরিবেষ্টিত দ্বীপ থেকে দুর্ধর্ষ অপরাধীরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। প্রথম দফায় ১৭৮৯ সালে কয়েদী উপনিবেশ গড়ে তুলে নাম দেওয়া হয় লর্ড কর্নওয়ালিসের নামে পোর্ট কর্নওয়ালিস। প্রথম দুই বৎসর এখানে কয়েদী উপনিবেশ রাখার পরে সেই উপনিবেশকে স্থানান্তরিত করা হয় উত্তর আন্দামানের নর্থ-ইস্ট 'হারবারে'। অসংখ্য কয়েদির মৃত্যু জনিত প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই উপনিবেশকেও ১৭৯৬ সালে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। ৬১ বৎসর পরে আঠারোশো সাতান্ন সালে সমগ্র ভারত ব্যাপী সিপাহী বিদ্রোহের ফলে জরুরিভিত্তিতে ইংরেজি শাসকেরা বাধ্য হয় দ্বিতীয় দফায় আন্দামানে কয়েদী উপনিবেশ স্থাপন করতে এবং পুরাতন পোর্ট কর্নওয়ালিস অঞ্চলকে (বর্তমানে যা পোর্টব্লেয়ার নামে পরিচিত) উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত করে। ৬২ বৎসর পূর্বে প্রথম কয়েদী উপনিবেশ গড়ার স্থান নির্বাচনের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লেঃ টি. এইচ. কোলব্রুক এবং লেঃ আর্চিবল্ড ব্লেয়ারকে সার্ভে (survey) করার জন্য পাঠান। লেঃ আর্চিবল্ড ব্লেয়ারের নামানুসারে পরবর্তীকালে পোর্ট কর্নওয়ালিস নামের পরিবর্তে পোর্টব্লেয়ার নাম চালু হয়। দ্বিতীয় দফাতে শুধু যে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের পাঠানো হতো তাই নয় তার সাথে সিপাহী বিদ্রোহের সাথে যুক্ত সৈনিক এবং অন্যান্য দেশদ্রোহী ও ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহীদের এখানে নির্বাসনে পাঠানো হতো। প্রথম দফার মত প্রথমদিকে চাত্থাম দ্বীপে কয়েদী উপনিবেশ গড়ে তোলার পরে জল কষ্টের জন্য রস আইল্যান্ড দ্বীপে কয়েদী উপনিবেশ স্থানান্তরিত করা হয়। ১৮৫৮ সালের ১০ ই মার্চ দুশ জন সিপাহীকে দ্বীপান্তর নির্বাসন দিয়ে যে দ্বীপান্তর পর্ব শুরু হয়ে কয়েদীর জীবন শুরু হয়েছিল তা শেষ হয়েছিল ১৯৪২ সালের ২৩শে মার্চ যেদিন জাপানিরা পোর্ট ব্লেয়ার অধিগ্রহণ করে সেলুলার জেলের দরজা খুলে দিয়ে সমস্ত বন্দীদের মুক্ত করে দিয়েছিল। ইতিমধ্যে ১৯৩৮ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শেষ দলটি আন্দামানের সমুদ্রতটকে 'আলবিদা' জানিয়ে মূল ভারত ভূমিতে ফিরে আসেন।
এরপরে আমরা আলোচনা করব আন্দামানে কয়েদি উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা এবং তার পশ্চাদপটের ঘটনাবলী। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপ থেকে আগত বেশ কয়েকটি জাহাজ আন্দামানের নিকটবর্তী অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সমুদ্রে ভেঙে পড়ার পরে জাহাজের নাবিক ও কর্মীরা দ্বীপগুলিতে আশ্রয় নেওয়ার পরে আদিম নেগ্রিটো জনজাতিদের দ্বারা তীর বিদ্ধ হয়ে মারা যায় অথবা তাদেরকে হত্যা করা হয়। এছাড়াও এই অঞ্চলে জলদস্যুদের উপদ্রবের মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন দেশের যাতায়াতকারী জাহাজগুলির নাবিক ও কর্মীদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দানের উদ্দেশ্যে আন্দামান দ্বীপ সমূহের কোন এক সুবিধাজনক স্থানে একটি পোতাশ্রয় বা 'হারবার' স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। দ্বিতীয়ত দুর্ধর্ষ অপরাধীদের জন্য এক দুর্ভেদ্য কয়েদী উপনিবেশ স্থাপন করা যাতে তারা কোনোভাবেই পালিয়ে যেতে না পারে। দুই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ১৭৮৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বীপপুঞ্জে স্থান নির্বাচনের জন্য লেফটেন্যান্ট টি. এইচ. কোলব্রুক এবং লেফটেন্যান্ট আর্চিবল্ড ব্লেয়ারকে পাঠান এবং তারা চাত্থাম দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। লর্ড কর্নওয়ালিসের সময়ে স্থাপিত এই পোতাশ্রয়ের নাম হয় পোর্ট কর্নওয়ালিস। সাত বৎসর পোর্ট কর্নওয়ালিস এবং উত্তরের নর্থ ইস্ট হারবারে উপনিবেশ থাকাকালীন অসংখ্য কয়েদির মৃত্যুর ফলে উপনিবেশ বন্ধ করা হয়। এর প্রায় ৬২ বৎসর পরে দ্বিতীয়বার পুনরায় উপনিবেশ স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত এক কমিটি পুরাতন পোর্ট কর্নওয়ালিসে উপনিবেশ স্থাপন করার পক্ষে মত প্রকাশ করার পরে ১৮৫৮ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি উপনিবেশ স্থাপন করা হয়। প্রথমবার উপনিবেশ স্থাপন করার পরে এবং পোতাশ্রয় নির্মাণ করার ফলে জাহাজগুলি জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল। দ্বিতীয়বার উপনিবেশ স্থাপনের পরে ডাক্তার জে. পি. ওয়াকার উপনিবেশের প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট হন এবং তাঁকেই আধুনিক আন্দামানের জনক বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর সময়ে পোর্ট কর্নওয়ালিস নামের পরিবর্তে পোর্টব্লেয়ার নামকরণ করা হয়। কিন্তু চাত্থাম দ্বীপে জলকষ্ট শুরু হওয়ায় কয়েদি উপনিবেশকে পোর্ট ব্লেয়ারের সন্নিকটে রস আইল্যান্ড দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়।
ক্রমশঃ
Please do not enter any spam link in the comment box.