রুটির দাম


লেখক: শিবাঙ্গণ


          সন্তুর মনটা আজ ভীষণ খারাপ, একরকম কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েই পরেছিল খিদের জ্বালায়। ভিক্ষা করে এক বাবু একটা পাউরুটি দিয়েছিলেন, সেটাও ও দিয়ে দিয়েছে নেড়ি কুকুরটাকে। কুকুরটা ওর ঠিক পোষা নয়, তবে এই ব্রিজটার নিচে সেও থাকে, সেদিক থেকে দেখতে গেলে সন্তুর প্রতিবেশী। তবে ওর অবস্থাও ভালো নয়, বয়স হয়েছে, হাড় ক'খানা ডিগ ডিগ করছে, আর কিছু না হোক, ওর একটু পেটভরে খাওয়া দরকার। খুব কষ্টে ছিল বেচারা, স্বজাতি কোন্দলে বেজায় আঘাত পেয়েছে। সন্তু যতজনকে চেনে তারমধ্যে এই কুকুরটাকে দেখেই ও মনে মনে ভাবে, যাক, ও নিজে তো অন্তত ওটার থেকে ভালো আছে, অন্তত ওর নিজের স্বজাতি কোন্দলের পর পরে। তবে খিদে পেলে আর কি করবে, খালি পেটে যে যুক্তি তক্কো মানে না।

          অতিমারিতে মা বাবা দুজনেই মরে গেল, কোথাকার এক দুর সম্পর্কের কাকা এসে বাড়িতে জাঁকিয়ে বসল তার নিজের সংসার নিয়ে। আর দু সপ্তাহ ঘুরতে ঘুরতেই সন্তুর স্থান হলো ব্রিজের নিচের ঝুপড়িতে। ব্যাপারগুলো পর পর সন্তু নিজেও মেলাতে পারে না। ভাবতে ভাবতে ঘুম আসে, আর ঘুম থেকে উঠে আবার সেই গ্যারেজ, এভাবেই দিন এক এক করে কেটে যায় সন্তুর। কোনো দিশা দেখতে পায় না। আজও ঘুমিয়ে পরার আগে ওর ছোট্ট কৃষ্ণ ঠাকুরের ছবিটাকে বুকে জড়িয়ে ও খুব কেঁদেছে, ও ঠাকুর, একটু খেতে দাও না, গো। আমারও যে বড্ড খিদে পেয়েছে। কুকুরটার জন্য তো তবু একটা রুটির জোগাড় হলো, কিন্তু আমি কি খাবো?

          এই নাও, সন্তু, দেখো তোমার জন্য কি এনেছি? একটা শান্ত স্নিগ্ধ গলার স্বর শুনে উঠে বসে, সন্তু। একটা ছোট্ট ছেলে হাতে একটা রুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে।

          তখন চোখের জলটাও শুকিয়ে গেছে, সন্তুর। জিজ্ঞেস করে, এটা আমার জন্য?

          ছেলেটা কিছু বলে না, আলতো করে চোখ টিপে সম্মতি জানায়।

          সন্তু আর কোনো সময় নষ্ট করে না। একরকম ছিনিয়ে রুটিটা নেয়, ছেলেটার হাত থেকে। গোগ্রাসে খেতে থাকে। 

          ওর খাওয়া দেখে ছেলেটা হো হো করে হাসে, আহা আস্তে খাও, আস্তে খাও, বিষম লাগবে যে। যদিও সন্তু সে কথায় কান দেয় না। এখন খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করছে সন্তু, ঢক ঢক করে এক গেলাস জল খেয়ে নেয়। তুমি কে গো, আমার জন্য রুটি নিয়ে আসলে?

          আমার নাম কানাই, ওই পাড়ায় থাকি। দেখলাম তোমার খুব খিদে পেয়েছে...

          হ্যাঁ গো, দেখো না, সেই বিকাল থেকে কিছু খাওয়া হয় নি। আসলে আমি তো খুব গরীব। আমার তো মা বাবাও নেই....ওর গরীবিয়ানাটাকে সন্তু এত সহজে মেনে নিয়েছে, ওর আর বলতে সংকোচ হয় না।

কানাই: কে বলেছে, তোমার মা বাবা নেই, ওরা তো আমার কাছে আছেন।

সন্তু: যাহ, কি যে বলো না। তোমার কাছে কি করে থাকবে, ওরা তো মরে গেছে। আর সেই জন্যই তো আমি এত গরীব।

কানাই: কে বললো, তুমি গরীব? তুমি তো অনেক বড়লোক।

সন্তু: যাঃ, কি যে বলো, আমি বড়লোক, দেখছো আমার মা নেই, বাবা নেই, খাওয়ায় মতো কিছু খাবার নেই...

কানাই: হ্যাঁ গো, সন্তু, তোমার কাছে তো একটা রুটি ছিল, সেটা তুমি নিজে না খেয়ে.....

সন্তু: কি করবো, বলো, ও বেচারিই বা কি খাবে, আমার মত ওরও তো কেউ নেই। নেড়িটা তখন কানাইয়ের পায়ে জিভ দিয়ে চাটছে।

কানাই: হ্যাঁ, আমি তাই তো বললাম, তুমি খুব বড়লোক।

          এবার একটু রেগেই যায় সন্তু, ফালতু ফালতু ছেলেটা মশকরা করছে। ছেঁড়া পকেটের ভিতরের কাপড়টা দেখায়, দেখো একটা কানাকড়িও নেই।

কানাই: হ্যাঁ গো সন্তু, আমি এরকম অনেক সন্তুকে চিনি, যার পকেটে অনেক টাকাকড়ি আছে, কিন্তু নিজে না খেয়ে অন্যকে দিয়ে দেওয়ার মতো একটাও রুটি তাদের কাছে নেই।

সন্তু: তো কি হবে, টাকা তো আছে, টাকা দিয়ে ওরা রুটি কিনে খেতে পারবে।

কানাই: তা পারবে, বটে। কিন্তু সেই রুটি আমি খেতে পারবো না।

সন্তু: কেনো পারবে না? তুমি রুটি খাও না?

কানাই: খাই তো, কিন্তু সে সব অনেক দামী রুটি, ওরা কিনে দিতে পারবে না।

সন্তু: ওরা বেশি দাম দিয়ে কিনে দেবে, ওদের তো অনেক টাকা?

কানাই: না সন্তু, এরকম রুটির দাম ওরা দিতেই পারবে না, যেটা আমি খাই।

সন্তু: চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকে সন্তু, ওরে বাবা, অনেক দামী, সেই বড় বড় আলো ঝলমলে হোটেল গুলোতে পাওয়া যায়?

কানাই: নাহ, সেরকম নয়, সেখানে পাওয়া যেতেও পারে আবার নাও পারে। কিন্তু ওরা চাইলেই কিনতে পারবে না।

সন্তু: ধুর বাপু, কি যে বলো না, বুঝি না। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এই তো বললে, রুটি গুলো অনেক দামী।

কানাই : দামীই তো, অনে...ক।

সন্তু: তাহলে সেটা তুমি কোথা থেকে কেনো?

কানাই: আমি কিনি না তো।

সন্তু: ও তোমাকে কেউ কিনে এনে দেয়।

কানাই: আমি কারোও কিনে আনা জিনিষ নিই না। তোমরা ভালোবেসে দিলে আমি খাই।

সন্তু: আমি আর কোথা থেকে তোমাকে দেবো, আমি তো নিজেই....

কানাই : এই তো দিলে, একটু আগে।

সন্তু (অবাক হয়ে যায়): ধুর, আমি কখন তোমায় দিলাম, অন্যকেউ দিয়েছে হয়তো, তুমি গুলিয়ে ফেলেছো।

কানাই (হাসে) : গোলাবো কেনো, এই তো দেখো। পকেট থেকে সন্তুর দেওয়া রুটিটা বের করে দেখায়, কানাই।

সন্তু: আরে এটা তো আমি ওই নেড়ি টাকে...

          কানাই চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না।

সন্তু: হয় তুমি চোর, নেড়িটার থেকে নিয়ে নিয়েছ, নয় তুমি ...

কানাই: নয়তো, আমি... কি?

সন্তু: ওই নেড়িটা। বলেই খিল খিল করে হেসে ফেলে সন্তু।

কানাই: ঠিক ধরেছো, আমি তো ওই নেড়িটাই, আবার আমি তুমি ও, আবার আমি সেই লোকটা যে তোমাকে ওই রুটিটা দিয়েছিল, আবার আমি সেই সব বড়লোক সন্তু গুলোও, যাদের পকেটে অনেক রুটি, কিন্তু তারা রুটির মূল্যই জানে না।

সন্তু: অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এই ছেলেটা নির্ঘাত পাগল। ধুর বাপু, তুমি যাও তো, আমার মাথা খেও না।

কানাই: ঠিক আছে, এখন আসি তবে, আবার দেখা হবে। কানাই চলে গেলো।

সন্তু: কানাই, ও কানাই শোনো না, ও কানাই...একটা কথা...

কানাই: আমি এখন আসি, সন্তু।

সন্তু: চলে যাচ্ছ কেনো, কানাই, একবার শোনো না। আবার কবে আসবে, বলে যাও...

কানাই: আমি আবার আসবো সন্তু, তুমি যখন ডাকবে আমি তখনই আসবো। 

          ঘুমটা ভেঙে যায় সন্তুর, ধরমড় করে জেগে উঠে বসে। তখনও ওর সামনে পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে খাবারের থালাটা ঢাকা দিয়ে রাখা। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সন্তু, এটা কে রেখে গেলো, ওতো এত ভালো ভালো খাবার কোনো দিন চোখেও দেখে নি। মনের ভিতর কু গায়, খাবারগুলো খাবে... এগুলো ভুতুড়ে খাবার নয় তো?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !