লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
নবম পর্ব
রুম্পা কৃষক বিদ্রোহ: ১৮৭৮-৭৯ সালে দক্ষিণ ভারতের গোদাবরী জেলার কৃষকরা ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং তার ফলে কৃষকেরা নিজেদের শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। এই বিদ্রোহ ব্রিটিশরা দমনমূলক ব্যবস্থা নিয়ে বহু কৃষককে শাস্তি স্বরূপ দ্বীপান্তরিত করে। এরপরে ১৯২৪ সালে দ্বিতীয় রুম্পা কৃষক বিদ্রোহ হয় সিতারামা রাজ্জুর নেতৃত্বে। পশ্চিম গোদাবরী জেলা ও বিশাখাপত্তনম জেলায় বিদ্রোহ প্রবলভাবে বিস্তৃত হয়ে ওঠে। ১৯২৪ সালে সিতারামা রাজ্জু ও তার বেশ কিছু অনুগামী ব্রিটিশের সাথে বীরত্ব সহকারে লড়াই করে শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। বহু কৃষক যোদ্ধা গ্রেফতার হন এবং বিচারে তাদেরকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত করে ব্রিটিশ সরকার আন্দামানে নিয়ে আসেন।
বার্মা কৃষক বিদ্রোহ: এই বিদ্রোহ থারাওয়াদি কৃষক বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৯২৮ সালে ডাক্তার সয়া সেনের নেতৃত্বে General council of Burmese Association ব্রিটিশের সঙ্গে সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করে। ১৯৩০ সালে ডিসেম্বর মাসে ডাক্তার সয়া সেন সমগ্র ব্রম্ভদেশে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করেন। পরে ডাক্তার সয়া সেন ব্রিটিশ কর্তৃক বন্দি হন এবং ব্রিটিশরা তাকে ফাঁসি দেয়। এরপরে বহু সংগ্রামী কৃষককে ব্রিটিশরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে আন্দামানে পাঠিয়ে দেয়।
মোটা বিদ্রোহ: দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূলে মোপলা জনজাতিরা খিলাফত আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রকাশ্যে বৃটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মোপলাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তি চাড়া দিয়ে ওঠার পরে তাকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশরা তাদেরকে দণ্ডিত করে শর্তসাপেক্ষে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত করে।
সবার শেষে আন্দামানে দণ্ডিত হয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সেলুলার জেলে আসেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কতজন এখানে এসেছিলেন তাদের সংখ্যা বাদ দিলে সিপাহী বিদ্রোহ ও বৃটিশ বিরোধী অন্যান্য বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী কতজন আন্দামানে এসেছিলেন তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। কিন্তু বন্দির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যায়। যার জন্য কয়েদী উপনিবেশ স্থাপনের পরে যেখানে ১৮৫৭ সালে কয়েদীর সংখ্যা ছিল ৭৭৩ জন পরবর্তী চার দশকের মধ্যে সেই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১৬১০৬ জন। অর্থাৎ বিচারের নামে প্রহসন করে যত সংখ্যক বিদ্রোহী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বীপান্তরিত করা যায় ততই ব্রিটিশের পক্ষে মঙ্গল।
এ্যাবারডিনের যুদ্ধের পরে ব্রিটিশরা কয়েদী উপনিবেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে পোর্ট ব্লেয়ারের দুই প্রান্তে দুটি কামান বসায় যাতে পুনরায় আদিম জনজাতির আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। অবশ্য এর পিছনে আরও একটি কারণ ছিল যে কয়েদীরা বিদ্রোহ করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে তাদেরকে যাতে সহজেই কামান চালিয়ে দমন করা যায়। এছাড়াও উপনিবেশে যাতে ব্রিটিশরা ভালো ভাবে বসবাস করতে পারে তার জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং ইংরেজ শাসকদের বাংলো ও বাসস্থান নির্মাণ, সৈন্যদের ব্যারাক, সরকারী বাসভবন, চিকিৎসা পরিষেবা কেন্দ্র, হাসপাতাল দ্রুতগতিতে নির্মাণ করে। ভাইপার দ্বীপে ফাঁসির মঞ্চ এবং চাত্থাম দ্বীপে একটি আধুনিক কাঠ চেরাই কল নির্মাণ করে। এছাড়াও আদিম জনজাতির মানুষদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াসে জঙ্গল সন্নিহিত বিভিন্ন স্থানে কুটির নির্মাণ করে প্রধানত গেট আন্দামানিজদের জন্য এবং বিভিন্ন কল্যাণ মূলক কার্যক্রম পরিচালিত করে।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি দ্বিতীয় দফায় কয়েদী উপনিবেশ চাত্থাম দ্বীপ থেকে জলকষ্টের জন্য রস আইল্যান্ডে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম জেলখানা ও ফাঁসির মঞ্চ স্থাপিত হয়েছিল ভাইপার দ্বীপে। ভাইপার দ্বীপের নিচু এলাকা গুলি মাটি ভরাট দিয়ে সমতল করে তার উপরে ইটের দেওয়াল ও কংক্রিটের ছাদ নির্মাণ করে চারটি ছোট জেলখানা এবং একটি বড় জেলখানা তৈরি করা হয়। দ্বীপের সর্বোচ্চ অংশে লাল রং করা ফাঁসির মঞ্চ করা হয়েছিল যাতে ফাঁসির সময় দূর থেকে সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। বিদ্রোহী সিপাহিদের অসীম সাহস ও লড়াকু মানসিকতাকে বশে আনার জন্য জেলখানাতে বন্দীদের পায়ে শিকল পরানো থাকতো যাতে তারা পালিয়ে যেতে না পারে। এই শিকলের আওয়াজ বহুদূর থেকে শোনা যেত। সর্বক্ষণ পায়ে শিকল পরিয়ে রাখার জন্য তাদের পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হতো। এই অবস্থাতেও তাদের কঠোর কায়িক পরিশ্রম করানো হতো এবং যে বন্দী সেই অবস্থায় কায়িক পরিশ্রম করতে অস্বীকার করতে তাদের নির্মম ভাবে বেত্রাঘাত করা হতো অথবা অন্যান্যভাবে শাস্তি দেওয়া হতো। এছাড়াও বিনাচিকিৎসায় তাদের পায়ের ক্ষত স্থান বিষাক্ত হয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়তো অথবা মৃত্যুমুখে পতিত হত।
ক্রমশঃ
Please do not enter any spam link in the comment box.