চীনের কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা


লেখক: শংকর ব্রহ্ম


            চীন সাহিত্যের প্রধান ঐতিহ্য তার সুদীর্ঘ কালের ব্যাপ্তি ও অভিজ্ঞতা, অভিন্নতা এবং যুক্তিগ্রাহ্যতা।

             খ্রীষ্ট পূর্ব ছয় শতাব্দীতে যে কবিতা বা গদ্য সাহিত্য পাওয়া গেছে তা (প্রকাশের ভাষার ও ভঙ্গির ভিন্নতা ছাড়া) মূলতঃ অভিন্ন রয়ে গেছে আজও। ধ্বনির পরিবর্তে ভাবমূলক লিপি পদ্ধতি ও ব্যাকরণের সল্পতায় তা সম্ভব হয়েছে।

              চীন যুগে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একতাবদ্ধ করার পর প্রকাশের একতার প্রচেষ্টা হান যুগে (২০৬ খ্রীস্ট পূর্ব- ২২০ খ্রীষ্টাব্দ) আরও দৃঢ়মূল হয়েছে। এই সময় তারা বহির্জগত বিচ্যুত হওয়ায় সাহিত্যের স্থিতবস্থা থেকে গেছে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে তার কিছুটা পরিবর্তন হয়।

              বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।

               প্রাচীন কনফুসীয় সাহিত্য এবং পাঁচ ও সাত অক্ষরে লেখা শিহ্ কবিতা (জাপানী হাইকু কবিতার মতো) এদের প্রাচীন সাহিত্যের সম্পদ।

         প্রাচীনতম যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত চীনের কাব্য রচনা মূখ্যত রাজকর্মচারীর ব্যাপার ছিল, একমাত্র ব্যতিক্রম তাং যুগের শ্রেষ্ট এবং বিশ্বের অন্যতম কবি 'লি পো'।


লি পো (৭০৫- ৭৬২ খ্রীঃ)

-------------------------------

টিয়া

----------


দল বেঁধে কুঞ্জবনে সুন্দরীরা রত্ন সাজে

মনে মনে ভাবে কত কি যে,

কুঠরীর গোপন খবরগুলি,

বলি বলি করেও বলে না,

আকুলি বিকলি করে মনে।

কিন্তু টিয়ার খাঁচা বড় বেশী কাছে এসে দেখে

কোন কথা বলার সাহস নেই বুকে।


স্তব্ধ রাতে

---------------


খাটের পায়ার কাছে কি এতো করছে চিকমিক

এখনই কি তুষার পাত শুরু হয়ে গেল?

উঠে বসে দেখি তা আলোর ঝিকমিক

চাঁদ এসে ঘরে ঢুকে আছে,

আবার শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবি

ঘরে একা প্রিয়া বসে আছে।


নানকিং পানশালায় বিদায়

-----------------------------------


শিমূলের তুলো বয়ে আনা দমকা বাতাস

সহসা এ পানশালা মদির গন্ধে ভরে তোলে

উ-প্রদেশের তরুণী সুরা ঢেলে বিদায় জানাতে

এসে 

শহরের বন্ধুদের সাথে পানে পীড়াপীড়ি করে,

পেয়াল উজার করে তারা পান করছে যখন,

আমার বিদায় সম্ভাষণ,

আহা যাও পুবে ছোটা ওই নদীটিকে বল,

বন্ধুর প্রেমের চেয়ে 

আরও দূরে কখনও সে যেতে পারে কিনা?


        সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট,মানবিকতা বোধ,যুক্তিবাদ,ব্যক্তিগত অনুভূতির সহজ প্রকাশ,অতীন্দ্রিয়তার স্পর্শ চীনা কবিতার চিরন্তন বৈশিষ্ট।

       বিখ্যাত চীনা সাহিত্যের সমালোচক 'লিউ হ্ সি এহ্'( ৪৬৫-৫২২ খ্রীঃ) বলেছেন, " বৎসর ও মাস ছুটে চলে যায়, আত্মা চিরস্থায়ী নয়, শুধু লেখার মধ্য দিয়েই মানুষ তার খ্যাতিকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে পারে এবং আপন কীর্তিগুলোকে ব্যাপ্তি দিতে পারে।"

তাই দেখা যায়, সরকারী আধিকারিক থেকে সম্রাট, সম্রাট-প্রিয়া, প্রধান মন্ত্র, সেনাপতি, রাজনীতিবিদ, সন্ত, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ নর - নারী সকলেই কবিতা লিখেছেন।

       গ্রীক বা সংস্কৃত কাব্যে যেমন মহাকাব্য আছে চীনা কাব্যে সেরকম কিছু নেই। শুধু পাওয়া যায় গীতি কবিতা। চীনা সাহিত্যে কাব্যের নায়ক নায়িকারা কোন দেব দেবী নয়, মর্তের মানব মানবী।

    বিপুল চিনা সাহিত্য সম্ভারে, দেশপ্রেম থাকলেও যুদ্ধের প্রশস্তি বা যৌনতার কোন নাম গন্ধ নেই। বাস্তব জীবনের দুঃখ কষ্টের রূপয়ণ করেই তারা চরম আনন্দ পেয়েছে।

       চীনের আদিতম কাব্যগ্রন্থ কনফুসিয়াস ( তার চিনা নাম - কুং ফু ৎজু- জন্ম ৫৫১ খ্রী.পূঃ) সংকলিত 'শিহ্- চিং'। তিন হাজার কবিতা থেকে নির্বাচন করে এই গ্রন্থে তিনশ' পাঁচটি(৩০৫) সুরানুক্রমিক সাজানো হয়েছে।

         এর অধিকাংশই লোকগীতি, বাকী অংশের নাম কুয়ো পেং বা 'দেশের হালচাল'।

         তাং যুগকে(৬১৮-৯০৭ খ্রীঃ) চীনা কবিতার স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময়ের বিখ্যাত কবিরা হলেন-লি পো (যাদুকর কবি নামে খ্যাত), তু ফু ( ঋষি কবি নামে খ্যাত), পাই চু-য়ি মেং, হাও জান প্রমুখ। কবি তু ফু এবং লি পো দু'জনে বন্ধু ছিলেন।


তু ফু (৭১২-৭৭০ খ্রীঃ)

---------------------------

রাতের ভাবনা,যুদ্ধ ও শান্তি

------------------------------------


বাগান থেকে ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢোকে জ্যোৎস্নায়

চাঁদের কিরণ নাচে পাগলের মতো,

বাইরে পড়ছে শিশির, আকাশের তারাগুলি দেখে।

জোনাকিরা এধারে ওধারে ভেসে চলে যায়

নদীচরে জলচর পাখি ডাকে তার সঙ্গীনীকে।


আর আমি?

যুদ্ধ বিদীর্ণ পৃথিবীর কথা ভেবে

অশান্তিতে ঘুমাতে পারি না।


ফুলের দিকে তাকিয়ে

----------------------------


জীবনের চেয়ে ফুল বেশী ভালবাসি

ভেবো না ভুলেও,

কুসুম শুকিয়ে গেলে ভয়ে হীম হয়ে যাই,

চোখের পলকে আমিও জরাজীর্ণ হবো।


ফুলের পাপড়িগুলি কত না সহজে

শুকিয়ে ছড়ায় চারিদিকে,

আহা কুঁড়িগুলি আরও ধীরে বিকশিত হলে

কত না যে ভাল হতো বলো?


       লি পো-র কবিতার যাদু বাস্তবতা মায়াময় করে তুলেছে তার কাব্যকে। হৃদয় নিঙড়ানো সব শব্দ ব্যবহার পাঠককে আকুল করে তুলেছে।

       এর পাশাপাশি লোকায়ত সাহিত্য ধারাও অব্যাহত ছিল নিশ্চিৎ ভাবেই।

        তাং যুগের শেষ দিকে কাব্যে বিষয়বস্তুর চেয়ে, ধ্বনি উৎকর্ষের প্রাধান্য দেখা দেয়।

        বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিদেশী সাহিত্যের প্রভাবে (বিশেষ করে অনুবাদ সাহিত্য পড়ার ফলে) তাদের ঐতিহ্যবাহী চিন্তাধারায় চিড় ধরে।তারা তখন নতুন কাব্য ধারার মধ্য দিয়ে আপন সত্তাকে খুঁজে পেতে চাইল।

     আফিনসেবী দরিদ্র চীন দেশের উর্বর মাটিতে, মার্কস বাদ বীজ বপনের উর্বরক্ষেত্র খুঁজে পেল।

         ১৯১৯ সালের আন্দোলন মূলতঃ রাজনৈতিক হলেও, এর ফলে আধুনিক চীনা কবিতার জন্ম হলো। ওয়েন ই-তো, হ্ স্ উ, চিহ্-মো, কুয়ো-মো-জো প্রমুখ চীনা কবিরা পাশ্চাত্য সাহিত্যের রোমান্টিকতার সঙ্গে পরিচিত হলেন। তাঁরা ভাষার সৌকুমার্যের উপর জোর দিলেন।

        সাম্প্রতিক কালে চীনা সাহিত্যের প্রেরণা রাজনৈতিক সাম্যবাদ প্রচারের ফলে,কবিতা তার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রচার সাহিত্যে পরিণত হয়েছে।


মাও ৎসে তু (১৮৯৩-১৯৭৬ খ্রীঃ)

--------------------------------------------

তিনটি কবিতা

--------------------


১)


গিরি চূড়াগুলি

দ্রুত অশ্বে, উদ্যত চাবুক,পৃষ্ঠাসন কখনও না ছেড়ে

পিছনে তাকতে ছিল ভয়,

কারণ আকাশ মাথার উপরে দু'হাতের সামন্য

তফাৎ।


২)


গিরি চূড়াগুলি

ঝাপিয়ে চূর্ণতাকামী সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ যেন তারা,

কিংবা পূর্ণ উল্লম্ফনের ছোটা

দশ সহস্রাশ্ব যেন,সংগ্রাম সাগরে।


৩)


গিরি চূড়াগুলি

সুনীর ত্রিদিবভেদী,শীর্ষ বিন্ধু নয় অনুজ্জ্বল

আকাশ পড়ত বুঝি ভেঙে

এই স্তম্ভগুলির অভাবে।


           অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী চীন অর্থাৎ তাইওয়ানের বর্তমানের কবিতা একটি অপূর্ব

রূপ নিয়েছে।১৯৪৯ সালের আগে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে তাইওয়ান জাপানীদের দখলে ছিল। জাপানী ভাষা ছাড়া অন্যকিছু ছাপা হতো না। এমনকি পান্ডুলিপি আকারেও কিছু পাওয়া যায়নি।

           ১৯৪৯ সালে মূল ভূখন্ডের সংস্কৃতি বহন করে কুড়ি লক্ষ চীনা সৈন্য তাইওয়ানে আসে।

মূল ভূখন্ড থেকে তাইওয়ান এক সংকীর্ণ উপসাগর দিয়ে বিচ্ছিন্ন ও মানসিক বিচ্ছিন্নতাও হযতো অতলান্তিক। তাইওয়ানের কবিরা একদিকে যেমন চীনের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ভোলেনি,অন্যদিকে তেমনি বহির্জগতের সঙ্গে নিবিড় সংযোগের ফলে নতুন ধ্যান ধারণা, আঙ্গিক গ্রহণ করে, অকল্পনীয় সৌন্দর্যময় কাব্য সৃষ্টি করেছে।

           দুই ধারার কাব্য স্রোত স্ব স্ব বর্ণবৈশিষ্টে

অভিন্ন হলেও সতন্ত্র বৈচিত্র নিয়ে বয়ে চলেছে। কোনদিন ওতপ্রতভাবে একধারা হবে কিনা সে প্রশ্নের উত্তর আজও অমীমাংসীত।


কিছু তাইওনান কবিতা

------------------------------

য়াং হুয়ান (১৯৩০-১৯৫৪ খ্রীঃ)

--------------------------------------

কবিতা

-------------


কবিতা অমর পুষ্প

জীবন মৃত্তিকায় উপ্ত হতে হয় তাকে,

কবিতা কাকলি ভরা পাখি

গীতিময় প্রাণবন্ত হৃদয়ে সবার।


মরি যে লজ্জায়

তুমি এলে যে কবিতা লিখি হৃদয়ে আমার,

তারা শুধু কালো অক্ষর

কবিতার বিবর্ণ নমুনা?


য়া হ্সুউয়ান (১৯৩৩ খ্রীঃ - মৃত্যু জানা নেই)

------------------------------------------------------

ঈশ্বর

------


ঈশ্বর একা

চুপচাপ বসে গীর্জার জানলার নীচে,

কেন না বেদীটি থাকে

পুরহিতের জবর দখলে।


ফাং হ্সিন( জন্ম - ১৯২৯- মৃত্যু জানা নাই)

-----------------------------------------------------

খোলা টেরিফোন বুথ

--------------------------


সঙ্গীহীন জনৈক যুবক

যুবতীর হাসি যেন একমুঠো চকচকে টাকা

মেঝেতে ছড়াল টুং টাং,

আমি নই খোলা টেলিফোন বুথ

আঃ নয় কখনোই -


এমন কি প্রত্যাশার মুদ্রাটিও তাতে

ফেলা যাবে না কখনও।


হ্সিউং হুং ( জন্ম- ১৯৪০- মৃত্যু জানা নেই)

------------------------------------------------------

প্রতিশ্রুতি

-----------


একদিন তোমাকে তো আর আমি লিখব না চিঠি

তখন জানবে তুমি আমি আর নেই,

যখন অনেক দেরী হয়ে যাবে সখী

আমার দরজায় এসে যদি তুমি কর করাঘাত।


মরে গিয়েও প্রাণবন্ত থেকে যাব

শুধু প্রাণটুকু মিশে যাবে পঞ্চ উপাদানে,

স্রোতশীল নদীকে বলে যার আমার বেদনা

ঝিরি ঝিরি বাতাসকে বলে যাব

তোমাকে পাঠাতে সোহাগের কথা।


কাঁপা কাঁপা বাতাস এসে ছড়াবে আমার দীর্ঘশ্বাস

আগুনের শিখায় হবে বিচ্ছুরিত আমার কামনা

তুমি তুলে নেবে তাই,পৃথিবীতে এ দেহের রক্ত

জন্ম দেবে অজস্র সুগন্ধী গোলাপ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !