সবুজ দ্বীপ আন্দামান (দশম পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

দশম পর্ব

          দীর্ঘ চল্লিশ বৎসরে বন্দীর সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়াতে, চিকিৎসার পরিকাঠামো না থাকাতে এবং পুরুষ ও মহিলা বন্দীদের একত্রে রাখা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বন্দীদের থাকার প্রতিবিধানের নিমিত্তে ১৮৯০ সালে তিন সদস্যের এক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যবস্থা উপনিবেশ কর্তৃপক্ষ অবলম্বন করে। সুপারিশ অনুযায়ী, ১) মহিলা বন্দীদের পোর্ট ব্লেয়ারের এ্যবারডিন এলাকার কাছাকাছি সাউথ পয়েন্ট এলাকাতে টিনের ছাউনি দেওয়া একটি গৃহে বন্দী করে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। ২) হ্যাডোতে একটি পৃথক জেলখানা স্থাপন করা হয়েছিল ৩) প্রথম ছয় মাস বন্দীদের রস আইল্যান্ডের নিকটস্থ পোর্টব্লেয়ারে রাখার জন্য সেলুলার জেল নামে একটি নূতন জেলখানা স্থাপনের বিশেষ প্রয়োজন অনুভূত হয়। ৪) বন্দীদের তত্ত্বাবধান করার জন্য এই সেলুলার জেলে একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ কারাধ্যক্ষ নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার কয়েদি উপনিবেশের অধীক্ষকে ৬০০ কক্ষ বিশিষ্ট সেলুলার জেল নির্মাণের প্রয়োজনীয় স্থান নির্বাচন এবং কারাকক্ষ নির্মাণের পরিকাঠামো তৈরীর আদেশ দেন। দক্ষিণ ভারতের কান্নানোর জেলের সেলের মাপ অনুযায়ী সেলুলার জেলের কক্ষগুলি সাড়ে তেরো ফুট লম্বা ও সাড়ে সাত ফুট চওড়া করা হবে বলে স্থির করা হয়। উচ্চতা ১৫ ফুট এবং বাতাস চলাচলের জন্য মেঝে থেকে ৯ ফুট উঁচুতে এক ফুট চওড়া ও তিন ফুট লম্বা মাপ বিশিষ্ট গবাক্ষ থাকবে। প্রত্যেকটি সেলের সামনে লোহার গরাদের দরজায় একটি 'বোল্ট' কয়েক ইঞ্চি দূরে দেয়ালের মধ্যে এক গর্তের ভিতরে ঢুকিয়ে তালা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে যাতে বন্দীরা গরাদের ফাঁক দিয়ে কোনভাবে তালার নাগাল না পায়। কারা কক্ষগুলির সামনের দিকে চার ফুট চওড়া একটি বারান্দা থাকবে। সেলুলার জেলে বন্দীদের জন্য ৬৯৬ কক্ষ বিশিষ্ট সাতটি ডানা বা উইং থাকবে এবং এই ডানাগুলি এক কেন্দ্রস্থলে মিলিত হয়ে একটি সেন্ট্রাল টাওয়ারের সাথে যুক্ত থাকবে। তিন তলা বিশিষ্ট সাতটি উইং বা ডানাগুলি যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানে একজন রক্ষী সেন্ট্রাল টাওয়ারের প্রতিতলার থেকে সাতটি উইংকে কড়া নজরদারিতে রাখবে। সাতটি উইংয়ের জন্য রাত্রে একজন করে মোট ২১  জন ওয়ার্ডেন তিন ঘন্টা অন্তর পালা করে পাহারাতে নিযুক্ত থাকবে। জেলখানার মূল ফটকের সামনে একজন সশস্ত্র প্রহরী এবং অপর একজন সশস্ত্র রক্ষী সেন্ট্রাল টাওয়ারের সর্বোচ্চ তলায় এবং তৃতীয় জন সশস্ত্র রক্ষী জেলখানার মূল প্রবেশদ্বারের ছাদে থাকবে যাতে সমগ্র জেলখানাটিকে কড়া নজরদারিতে রাখা যায়।

          কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দুটি স্থান নির্বাচিত হয়েছিল সেলুলার জেল স্থাপনের জন্য প্রথমটি পাহাড় ও পথের আপুর এর মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত যার আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৩৫০ ফুট এবং প্রস্থে ৩৩০ ফুট। দ্বিতীয় স্থানটি হল পোর্ট ব্লেয়ারের আটলান্টা পয়েন্ট, যার দৈর্ঘ্য ৭৯০ ফুট এবং প্রস্থ ২৩১ ফুট। এই স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৫  ফুট উঁচুতে। উপনিবেশের অধীক্ষক দুটি স্থান পরিদর্শন করে দ্বিতীয় স্থানে সেলুলার জেল স্থাপনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। উপনিবেশের দ্বিতীয় অধীক্ষক কর্নেল এন. এস. হর্সফোর্ড তার মত ব্যক্ত করেছিলেন যে ভূমিকম্প প্রতিরোধে তিনতলাবিশিষ্ট জেলখানার থেকে দ্বিতল বিশিষ্ট কারাকক্ষ উপযোগী। দুজন অধীক্ষকের প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিটির অন্যতম সদস্য ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স, ডাক আলফ্রেড সোয়েন লেথব্রিজ তার মতামত ব্যক্ত করে বলেছিলেন, সেলুলার জেলের স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে আটলান্টা পয়েন্টের অবস্থান সঠিক। কমপক্ষে ৬০০ কক্ষ বিশিষ্ট বন্দীনিবাস হবে এবং এক ব্লকের বন্দী অন্য বন্দীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। বন্দীদের দৈনন্দিন কাজকর্ম কড়া নজরদারির মধ্যে প্রত্যেক ব্লকের সামনের মুক্ত এলাকাতে হবে। মূল প্রবেশদ্বারের থেকে সামান্য ভিতরে একটি রান্নার জায়গা থাকবে যেখানে সমস্ত বন্দীদের খাবার প্রস্তুত হবে। জেলের ভিতরে একটি ছোট আকারের হাসপাতাল থাকবে।‍ জটিল ও মুমূর্ষু রোগীদের জেলখানার বাইরে হ্যাডো হাসপাতালে চিকিৎসা হবে। জেলখানার মুখ্য দেয়ালের উচ্চতা কমপক্ষে ১৫ ফুট করা দরকার। মূল প্রবেশদ্বার এ্যবারডিন জেটীর কাছাকাছি থাকবে। উপনিবেশের দ্বিতীয় অধীক্ষক কর্নেল হর্সফোর্ড এবং ডঃ লেথব্রিজের পরামর্শ ও সুপারিশ মেনে ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৩ সালে সেলুলার জেল স্থাপনের নির্মাণ কার্যের নির্দেশ দেন। ১৮৯৬ সালে নির্মাণকার্য শুরু হয়ে পরের দশ বৎসরে অর্থাৎ ১৯০৬ সালে এর নির্মাণকার্য শেষ হয়। সেই সময়ে মোট ৫ লক্ষ ১৭ হাজার ৩৪২ টাকা ব্যয় করে সাত ডানাওয়ালা ত্রিতল বিশিষ্ট এই জেলখানা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে মাত্র ৩৬ বৎসর পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান কর্তৃক আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করার পরে জেলখানার দুটি ডানাকে ভেঙে সেখানে জাপানি সৈন্যদের থাকার ব্যারাক তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালের পরে আন্দামান প্রশাসন আরও দু'টি ডানাকে ভেঙে সেখানে পন্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পন্থের নামানুসারে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেন বর্তমানে সেলুলার জেলের অবশিষ্ট তিনটি ডানার কয়েদী কক্ষগুলি অবশিষ্ট আছে। সাতটি উইংয়ে কিন্তু কারাকক্ষের সংখ্যা সমান ছিল না। একটি উইংয়ে সর্বাধিক কারাকক্ষ ছিল ১৫০ এবং সর্বনিম্ন ৬০টি। জেলখানার মূল প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মুক্ত পরিসরে বন্দীদের ফাঁসি দেওয়ার তিনটি মঞ্চ ছিল। প্রত্যেক উইংয়ের সামনের প্রাঙ্গণে ১৫ফুট x ১.৫ ফুট মাপের চৌবাচ্চাতে জেলের বাইরের একটি বড় চৌবাচ্চা থেকে জল এনে ভর্তি করা থাকত বন্দীদের ব্যবহারের জন্য। বড় চৌবাচ্চাটি পাম্পের সাহায্যে সমুদ্রের জলে ভর্তি করে রাখা হতো। প্রতি ছয়জন বন্দীর জন্য একটি করে পায়খানা ছিল যেখানে মলত্যাগের জন্য পাঁচ মিনিট সময় বরাদ্দ ছিল। ফাঁসির মঞ্চের কাছে দুটি পৃথক রান্নাঘর ছিল হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য।

ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !