লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
চতুর্দশ পর্ব
সমুদ্রের তলায় যে সী-শেলের বিরাট ভান্ডার সেগুলি জলের তলা থেকে তুলে আনে ডুবুরিরা। বিভিন্ন দ্বীপের চারপাশের সমুদ্র থেকে সিপি তোলার ইজারা বাৎসরিক ভাবে সরকারী দপ্তর থেকে বন্টন করা হয় বিভিন্ন ঠিকাদারদের। তারা এই সমস্ত সিপি তুলে শুকনো করে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পালিশ করার পরে কলকাতা ও মাদ্রাজের বড় বড় রপ্তানিকারকদের কাছে পাঠায় এবং পরবর্তী সময়ে এই সিপিগুলি ইউরোপ ও আমেরিকাতে রপ্তানি করা হয়। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বঙ্গোপসাগরের সিপির বিরাট কদর। সিপি সমুদ্র থেকে যারা উত্তোলন করে তাদের সিজন শুরু হয় সাধারণত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে এবং বর্ষার প্রারম্ভে সিপি তোলার কাজ শেষ হয়ে যায়।
সাবমেরিনের ভেতর থেকে আমরা ক্যামেরা ও মোবাইলের সাহায্যে ঘনঘন পরিবর্তিত দৃশ্যপটের ছবি তোলায় সবাই ব্যস্ত। প্রায় ৪৫ মিনিট সমুদ্রের তলদেশে থাকার পরে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করা হলো আমরা নর্থ বে' দ্বীপের নিকটে পৌঁছে গেছি এবং আমাদের জলযান এরপরে সমুদ্রের উপরিভাগে ভেসে উঠবে। সমুদ্রের উপরিভাগে ওঠার পরে দেখতে পেলাম সামনে ঘনবনরাজিনীলা নর্থ বে দ্বীপ। যেহেতু এখানে কোনো স্থায়ী জেটি নেই সেজন্য ভাসমান জেটির উপর দিয়ে আমরা সাবধানে তীর ভূমি স্পর্শ করলাম। সামনে সামান্য একটুখানি বেলাভূমি, তারপরে অস্থায়ী দোকানদারদের বিভিন্ন প্রকার শেডের পেছনে ম্যানগ্রোভের ঝোপ আর সারি সারি নারকেল গাছ। তার পিছনে পাহাড়ের চূড়ায় লাইটহাউসের বাতিস্তম্ভ আর পাহাড়ে বৃষ্টিস্নাত পাদুক, চুগলুম, দিদু, গর্জন এমনিই সব মহাবৃক্ষের সারি। সেগুলিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে বুনোলতা। দ্বীপে অস্থায়ীভাবে কিছু চা-কফি, স্ন্যাকস্, ভাতের হোটেল ও স্যুভেনিরের দোকান আছে। নিকটবর্তী পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্র নিয়ে সকালে আসেন এবং বিকেল চারটার মধ্যে ফিরে চলে যান। দ্বীপটি জনবসতিহীন বলে স্থায়ীভাবে কোন আবাসস্থল গড়ে উঠেনি। ক্রান্তীয় অঞ্চলের বৃক্ষসমূহ ও নারকেল গাছের সারি, সামনে আদিগন্তব্যাপী নীল জলের সমুদ্র। সাবমেরিন থেকে নামার পরে আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল পুনরায় সাবমেরিন এখান থেকে দুপুর দুটোর মধ্যে রস দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। ইত্যবসরে অনেক পর্যটক স্কুবা ডাইভিং, স্নোরকেলিং, জেটস্কি, স্পিডবোট, প্যারাগ্লাইডিং প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার বিনোদনমূলক জলজ ক্রীড়াগুলিতে অংশগ্রহণ করতে লাগলেন। আমরা বয়স্ক বলে এই সমস্ত খেলায় অংশগ্রহণ করলাম না। আমরা দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। বিভিন্ন সামুদ্রিক পণ্যের সম্ভারে দোকানগুলি সাজানো। পাহাড়ের উপরে লাইটহাউস দেখা যাচ্ছে। কিছু কম বয়সী পর্যটক লাইট হাউসের সমীপবর্তী হওয়ার জন্য ট্রেকিং করে যেতে লাগলো। অবশ্য প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সময়সীমা লক্ষ্য রেখেছেন অর্থাৎ সেই সময়ের মধ্যে সাবমেরিনে না উঠতে পারলে জনমানবহীন দ্বীপে রাত্রি বাস করতে হবে। যাইহোক দুপুর দুটোর সময়ে আমাদের জলযান এখান থেকে যাত্রা শুরু করে রসদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হল। ৪০ মিনিটের মধ্যে আমরা রসদ্বীপে যেয়ে পৌঁছালাম। জেটি থেকে ভূমিতে নেমে রসদ্বীপের মাটিকে প্রণাম করলাম কারণ এই দ্বীপে বহু বিপ্লবী শহীদ হয়েছেন। নর্থ বে দ্বীপ যেমন আনন্দ নিকেতন কিন্তু রস দ্বীপ বেদনার ভূমি। কত বিপ্লবী যে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। দৈহিক পরিশ্রমে তাঁদেরকে বাধ্য করা হতো ব্রিটিশের বাসস্থান, মানব গুহা নির্মাণ, তাদের আনন্দের জন্য সুইমিংপুল, নৃত্যগীতের জন্য প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করতে, বিপ্লবীদের শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে কারাগার, মৃত্যুদণ্ডের জন্য ফাঁসির মঞ্চ নিজেদেরকেই তৈরি করতে হত এবং তারপরে তাঁরা একদিন বধ্যভূমিতে যেয়ে শহীদ হতেন। জেটি থেকে নামার পরে সংরক্ষিত অভয়ারণ্যে হরিণের পদচারণা ও ময়ূরের কেকাধ্বনি ও নৃত্য পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। ১৯৪১ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প ব্রিটিশ নাগরিকদের বাধ্য করেছিল দ্বীপভূমি ত্যাগ করতে। এরপরে আসে জাপানি সৈন্যদের আক্রমণ এবং তারা দ্বীপভূমি দখল করে সেনা ঘাঁটি তৈরি করে। তাদের তৈরী বাড়ী ও ব্যারাকগুলির বেশিরভাগই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে এবং সেগুলির উপরে বিভিন্ন বিশালাকার বৃক্ষের শিকড় ও শাখাগুলি নেমে মুখব্যাদান করে আছে। কয়েকটি ব্যবহারযোগ্য বাড়ীতে ভারতীয় নৌবাহিনীর রুটি ও বিস্কুটের কারখানা এবং তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান তাদের প্রয়োজন মেটায়। এছাড়াও নৌবাহিনীর দপ্তর আছে। রসদ্বীপে নেমে পর্যটকেরা এখনো যা দেখতে পান সেগুলি হলো ব্রিটিশ আমলের গির্জা, অফিসঘর, মুখ্য কমিশনারের বাসস্থান, নৃত্য ও আমোদপ্রমোদের বলরুম, হাসপাতাল, ছাপাখানা, সুইমিংপুল, টেনিস খেলার জায়গা, পানীয় জল পরিশোধন কেন্দ্র প্রভৃতি। অভায়ারণ্যে যেমন হরিণ ও ময়ূর আছে তেমনি অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে পূর্ণ। ব্রিটিশ আমলে দ্বীপভূমিতে সরকারি দপ্তর, কারাগার, মুখ্য কমিশনারের বাসস্থান প্রভৃতির সাথে সুড়ঙ্গপথে যোগাযোগের জন্য গুহা গুলি তৈরি করা হয়েছিল যাতে বিপ্লবী বা শত্রুপক্ষের আক্রমণে প্রতিটি বিভাগ সুড়ঙ্গপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখতে পারে। দ্বীপের মধ্যস্থলে একটি মাঝারি আয়তনের পুষ্করিণী আছে এবং তার ঘাটগুলি বাঁধানো। অব্যবহৃত অবস্থায় থেকে জলের রঙ সবুজ হয়ে গেছে। পুকুরটির তীরে ভগ্ন গৃহগুলো অতীতের সাক্ষ্য দেয়। বর্তমানে পুকুরের চারদিকে বড় বড় গাছের সমারোহ। এখানে দু'ঘণ্টা থাকার পরে আমাদের জলযান পোর্ট ব্লেয়ারের রাজীব গান্ধী স্পোর্টস কমপ্লেক্সের উদ্দেশ্যে রওনা হল। আনন্দ ও বেদনার সাক্ষী হয়ে আমরাও ফিরে চললাম। আগামীকাল আমরা তিন দিনের সফরে মধ্য ও উত্তর আন্দামান অভিমুখে রওনা হব।
আন্দামানে আজ সপ্তম দিন। সকাল সাতটাতে আমাদের গাড়ি এসে হাজির। আমাদের লাগেজ নিয়ে গাড়ীতে উঠলাম কারণ এখানে আমাদের থাকার মেয়াদ গতকাল রাত্রে শেষ হয়ে গেছে। আজ আমরা স্থলপথে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে জারোয়া অধ্যুষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল পেরিয়ে মধ্য আন্দামানে প্রবেশ করবো। সংরক্ষিত বনাঞ্চল পেরোণার নিয়ম সকাল নটার মধ্যে যে গাড়ি গুলি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রবেশপথ জিরাকাটাং পৌঁছাবে সেগুলিকে পুলিশ প্রহরায় বনাঞ্চল পার করিয়ে মিডলস্ট্রেট জেটিতে পৌঁছে দেবার পরে সেখান থেকে পুনরায় গাড়ির কনভয় ছাড়বে জিরাকাটাং-য়ের উদ্দেশ্যে। শেষ গাড়ির কনভয় মিডলস্ট্রেট থেকে বিকেল তিনটায় ছাড়বে। একই সাথে যাওয়া ও আসার গাড়ি ছাড়া হয় না। এখানে উল্লেখ্য যে সকাল ছটায় প্রথম গাড়ীর কনভয় শুরু হয় এবং বিকেল তিনটায় শেষ হয়।
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে জিরাকাটাং চেকপোষ্টে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম সকাল সাড়ে আটটায়। যেয়ে দেখছি সামনে অসংখ্য গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যারা প্রথম কনভয় যাওয়ার পরে এসে পৌঁছেছে। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম, সরকারী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যেককেই মানতে হবে। সকালের রোদে চারিদিক ঝলমল করছে, দূরে ক্রান্তীয় অঞ্চলের বনভূমি। রাস্তার দু পাশে অনেক দোকান তবে সেগুলোর বেশিরভাগই চা-বিস্কুট, মুড়ি-তেলেভাজা ও খাবারের দোকান। আমরা একটি দোকানে যেয়ে বাঙালির মুড়ি ও তেলেভাজার স্বাদ নিতে ঢুকে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম সব গাড়ির আরোহীরা ও ড্রাইভারেরা মে যার গাড়িতে উঠে বসে পড়ছেন। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এর পরে গাড়ি ছাড়া শুরু হবে। মনের মধ্যে কৌতূহল ও একরাশ উৎকণ্ঠা আন্দামানের আদিম অধিবাসী জারোয়াদের দেখার। অবশেষে সকাল নটা পনেরোতে গাড়িগুলি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রবেশের কাগজপত্র পরীক্ষা করিয়ে যেতে শুরু করলো।
ক্রমশঃ
Please do not enter any spam link in the comment box.