সবুজ দ্বীপ আন্দামান (ত্রয়োদশ পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ত্রয়োদশ পর্ব

          পরের দিনে সকালে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট করে রিসর্ট থেকে সকাল সাড়ে ন'টায় বেরিয়ে গেলাম। আমাদের এখান থেকে পরের গন্তব্যস্থল নীল দ্বীপ বা শহীদ দ্বীপ। সকাল সাড়ে দশটায় আমাদের লঞ্চ ছাড়লো নীল দ্বীপের উদ্দেশ্যে। ১৮ কিলোমিটার দূরের নীল দ্বীপে যেতে স্টিমারের সময় লাগে দেড় ঘন্টার মত। নীল দ্বীপে আমাদের থাকার জায়গা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পর্যটন দপ্তরের অতিথিশালা 'হাওয়াবিল নেস্ট'-এ। জেটি থেকে অতিথিশালার দূরত্ব এক থেকে দেড় কিলোমিটার। আমরা একটি অটো করে অতিথিশালায় পৌছে দেখলাম আমাদের জন্য একটি দ্বি-শয্যা বিশিষ্ট শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর দেওয়া হল। এখানকার চেক্-ইন টাইম সকাল ১১ টা থেকে পরের দিন সকাল ৯ টা পর্যন্ত। অতিথিশালায় দুপুরের লাঞ্চ করে আমরা একটি অটো করে বেরিয়ে পড়লাম লক্ষণপুর সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। তার পূর্বে নীল দ্বীপের সম্বন্ধে দু'একটি কথা বলছি। নীলদ্বীপ লম্বায় প্রায় চার কিলোমিটার এবং চওড়াতে ছ' কিলোমিটার। দ্বীপের পশ্চিমে লক্ষণপুর এক নম্বর বেলাভূমি, উত্তরে ভরতপুর, দক্ষিণে রামনগর ও সীতাপুর সৈকত এবং পূর্বে বিজয়নগর। পোর্ট ব্লেয়ারের ৩৬ কিলোমিটার পূর্বদিকে এই নীল দ্বীপ অবস্থিত হ্যাভলকের মত এখানেও গ্রীষ্মে সর্বাধিক তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি এবং শীতকালে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শিক্ষিতের হার এখানেও শতকরা ৮৫ জন। ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জেমস নীলের নাম অনুসারে দ্বীপের নাম হয় নীল দ্বীপ, পরবর্তীকালে দ্বীপের নাম হয় শহীদ দ্বীপ। ১৯৬০ সালের পূর্বে দ্বীপটি জনমানবহীন ছিল। ১৯৬০ সালের পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত ছিন্নমূল হিন্দু শরণার্থীদের এখানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। দ্বীপটির একটি বৈশিষ্ট্য অন্য দ্বীপগুলির তুলনায় এখানকার জমি সমতল, যার ফলে অধিকাংশ জায়গায় ধান ও শাকসবজির চাষ হয়। দ্বীপের বাসিন্দাদের প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত তরিতরকারি পোর্টব্লেয়ার ও অন্যান্য বসতিপূর্ন দ্বীপগুলিতে সরবরাহ করা হয়। দ্বীপের অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও মৎস্য শিকার করা। দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাংশে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সুবাদে এখনো পর্যন্ত সবুজের আভা দেখা যায়। হ্যাভলকের মত পাঁচটি গ্রাম নিয়ে নীলদ্বীপ- এগুলি হল সীতাপুর, ভরতপুর, নীল কেন্দ্র, লক্ষণপুর ও রামনগর। এখানে উল্লেখ্য আন্দামানের পূর্বদিকে কুড়ি কিলোমিটার ব্যাপ্ত যে ছোট-বড় অসংখ্য দ্বীপমালা দেখা যায় তার মধ্যে শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপ আজকের পর্যটকদের কাছে স্বর্গভূমি। অসংখ্য দ্বীপমালার সমষ্টিকে 'রিচিস আর্কিপেলাগো' বলা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ নৌবাহিনী জরিপকারী জন রিচি প্রায় উনিশ বৎসর এই সমস্ত জনহীন দ্বীপগুলিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমীক্ষা চালিয়ে ছিলেন। তাঁর তৈরি ভূতাত্ত্বিক ম্যাপ পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৭ সালে কলোনি উপনিবেশ গঠনের উপযোগিতা উপলব্ধি করে রস দ্বীপে কলোনি উপনিবেশ, কারাগার ও ফাঁসির মঞ্চ স্থাপন করেন। ১৭টি দ্বীপ ও অসংখ্য খাঁড়ি নিয়ে এই দ্বীপমালার বেশীরভাগ অঞ্চল উঁচু-নীচু পর্বত ও গভীর জঙ্গলে আবৃত। তার মধ্যে হ্যাভলক দ্বীপ আয়তনে সর্বাধিক। হ্যাভলক দ্বীপ এবং রস দ্বীপের মাঝামাঝি জায়গাতে এই নীলদ্বীপ। অতীতে এই অঞ্চলগুলি গ্রেট আন্দামানীজদের বাসভূমি ছিল।

          লক্ষণপুর সমুদ্রসৈকতের প্রধান আকর্ষণ 'ন্যাচারাল ব্রিজ' বা 'হাওড়া ব্রিজ'। কেন যে হাওড়া ব্রিজ নাম হয়েছে বোঝা যায় না। বেলাভূমিতে প্রবেশ করে বাঁ দিকে কিছুটা গেলে এই হাওড়া ব্রিজ। চুনাপাথরের পাহাড় যেখানে সমুদ্রে এসে মিশেছে সেখানে শত শত বৎসর ধরে সমুদ্রের জলের ধাক্কা খেয়ে একটি যাতায়াতের রাস্তা সৃষ্টি করেছে যেটি পেরিয়ে ওপাশে যাওয়া যায়। তবে বেশি দূর না যাওয়াই ভালো, কারণ সমুদ্রে জোয়ারের সময় এই অঞ্চলগুলি জলে ডুবে যায়, ফলে ফিরে আসার পক্ষে খুব অসুবিধা হয়। পাহাড়ের উপরে গাছপালা। আমরা বিকেলের দিকে গিয়েছিলাম, তখন ভাটার সময়। সমুদ্রের বুকে ছোট ছোট পাথরের উপরে পা দিয়ে ওখানে যেয়ে সামান্য সময় কাটিয়ে আমরাও অন্যান্য পর্যটকদের মত ছবি তুললাম। এখান থেকে আমরা গেলাম ভরতপুর সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্রে স্নান করার বা সানবাথ নেওয়ার একটি আদর্শ জায়গা। সমুদ্রে বিভিন্ন ধরনের ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যাবস্থা আছে। কমবয়েসীরা সেগুলিতে অংশগ্রহণ করছে। বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে পদচারণা করে সূর্যাস্ত দেখার জন্য অপেক্ষা করলাম। অবশ্য সূর্যাস্ত প্রতিটি সমুদ্রসৈকতে প্রায় একই রকম। রুপোলি থেকে ডিমের কুসুম হয়ে সিঁদুর মেখে সমুদ্রের জলে সূর্যদেবের ডুব দেওয়া। গতকাল হ্যাভলকের রাধানগর সমুদ্রসৈকতেও একই জিনিস দেখেছি। ভরতপুর সমুদ্র সৈকত সূর্যোদয়ের জন্য বিখ্যাত। আগামীকাল সকালে যাওয়ার ইচ্ছা আছে যদি আকাশে মেঘ না থাকে। ভরতপুর সমুদ্র সৈকতের পরে রামনগর সমুদ্র সৈকতে, যেটি সূর্যাস্তের জন্য বিখ্যাত, সেখানে আর যাওয়া হলো না। আমরা ভরতপুর সমুদ্র সৈকত থেকে আমাদের আবাসস্থলের উদ্দেশ্যে ফিরে এলাম। হ্যাভলকের মত সমুদ্র এখানে পর্যটক আবাস স্থলের পাশে নয়। রাতের খাবারের পর সীমানার মধ্যে কিছুক্ষণ পদচারণা করে বিছানায় গন্তব্য স্থল। পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে এখান থেকে আমাদের বিদায় নিতে হবে দুটি রাত্রির অভিজ্ঞতা সারা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। পরের দিন সকালে আকাশ মেঘলা থাকার জন্য সূর্যোদয় দেখতে ভরতপুর বিচে যাওয়া হলো না। সকাল ন'টার মধ্যে আমাদের অতিথিশালা ছেড়ে যেতে হবে। আমরা ব্রেকফাস্ট করে জেটির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, কারণ আমাদের পোর্টব্লেয়ার ফিরে যাওয়ার স্টিমার সকাল সাড়ে দশটায়। দু'ঘণ্টা স্টীমারে করে সমুদ্রের বুকে জলবিহার করে পোর্ট ব্লেয়ারের ফিনিক্স বে জেটিতে এসে পৌঁছালাম দুপুর সাড়ে বারোটায়। এখান থেকে আমরা স্টেট ব্যাঙ্কের অবকাশ কেন্দ্র রাজীব গান্ধী নগরে যেয়ে দুপুরের লাঞ্চ করার পরে বিকেলে মেরিন মিউজিয়াম দেখে ও সন্নিহিত মেরিনা পার্কে কিছু সময় অতিবাহিত করে সন্ধ্যের পরে ফিরে এলাম। পরের দিন সকালে আমাদের নর্থ বে দ্বীপ ও রস দ্বীপে যাবার লঞ্চের টিকিট কাটা আছে।

          আজ আমাদের ষষ্ঠ দিন। আমাদের আজকের যাত্রা শুরু হবে রাজীব গান্ধী স্পোর্টস কমপ্লেক্স জেটি থেকে। এখান থেকে প্রথমে আমরা যাব ২৮ কিলোমিটার দূরের জঙ্গল পাহাড় অধ্যুষিত জনমানবহীন নর্থ বে দ্বীপ এবং সেখান থেকে রস দ্বীপ বা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দ্বীপ ঘুরে পোর্টব্লেয়ারে ফিরে আসা। সকাল সাড়ে নটাতে আমাদের যাত্রা শুরু হলো একটি সেমি সাবমেরিন জাতীয় নৌযানে। এই জলযানটি জলের তলায় ডুব দিয়ে আমাদের সমুদ্রের তলদেশের নিয়ে যেয়ে প্রবাল প্রাচীর এবং সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছ ও প্রাণিজগতের দেখিয়ে নিয়ে যাবে নর্থ বিডিপি আধুনিক নিরাপত্তা বিশিষ্ট সমুদ্র জয়ন্তীতে প্রবেশ করার পরে জলযানের নিরাপত্তাকর্মীদের অনুরোধে আমাদের লাইফ জ্যাকেট পড়তে হলো কারণ যেকোন রকম দৈব দুর্ঘটনায় এই লাইফ জ্যাকেট আমাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করবে জলের দুপাশ দিয়ে মোড়া যাতে পারিপার্শ্বিক সবকিছুই দৃশ্যমান হয় সমুদ্রের জলের উপরে অল্প সময় ভাসমান থাকার পরে ধীরে ধীরে সেটি সমুদ্রের তলদেশে চলে গেল সমুদ্রের তলদেশে যাবার পরে বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী, সরীসৃপ, শঙ্খ, কড়ি, সানডায়াল ও প্রবাল প্রাচীর দেখতে পেলাম। এ যেন এক নতুন জগৎ। আন্দামানে এই সমস্ত 'শেল'কে সিপি বলে। বিদেশের বাজারে বিশেষতঃ ইউরোপ ও আমেরিকাতে আন্দামানের সিপির বিরাট চাহিদা।

ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !