লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
ষোড়শ পর্ব
দুপাশে বিস্তৃত আন্দামানের সুউচ্চ গভীর জঙ্গল। যেতে যেতে মনে হতে লাগলো হয়তো গাছের আড়ালে কোন জারোয়াকে দেখতে পাবো আমাদের দিকে বিষমাখানো তীর-ধনুক নিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জারোয়া অধ্যুষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৩৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে মিডলস্ট্রেট জেটিতে যেয়ে পৌছালাম। জঙ্গলে কোন জারোয়াকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হলাম। অবশ্য এই দিনেই কদমতলা যাবার পথে জারোয়া স্ত্রী-পুরুষ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সমুদ্রের খাঁড়ির উপরে যন্ত্রচালিত লঞ্চের উপরে গাড়িগুলিকে তুলে আমরাও ওপারে নীলাম্বর জেটিতে যেয়ে পৌছালাম। অদূর ভবিষ্যতে হয়তোবা মানুষ কৃতকৌশল বিদ্যার সাহায্যে সমুদ্রের বুকের উপরে সেতু নির্মাণ করে যাতায়াতের পথকে আরও সুগম করবে এবং সময়ের সাশ্রয় ঘটবে। এই ভ্রমনকাহিনী লেখার সময়ে পোর্টব্লেয়ার রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক স্বামী প্রার্থনানন্দের কাছ থেকে জানতে পারলাম মিডলস্ট্রেট জেটিতে এখনও পর্যন্ত যন্ত্রচালিত নৌযানেই পারাপার হচ্ছে, তবে উত্তরা জেটিতে সমুদ্রের খাঁড়ির উপরে সেতু তৈরী হয়ে গেছে। নীলাম্বর জেটিতে পৌঁছাবার পরে ছোট যন্ত্রচালিত নৌকার সাহায্যে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বারাটাং চুনাপাথরের গুহা দেখাতে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরাও এইরকম একটি যন্ত্র চালিত নৌকার সওয়ারী হলাম। এই নৌকা গুলিতে ৮-১০ জনের বেশি লোক যেতে পারেনা। নৌকায় বেশি লোক হয়ে নড়াচড়া করলে নৌকাগুলি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা। নৌকায় বসার পরে নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক। নিরাপত্তার জন্য আমরাও লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। দুপাশে ঘনসবুজ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, মাঝখানে সমুদ্রের জল, মাথার উপরে নীল আকাশ। কিছুদুর যাবার পরে আমাদের 'নয়াদের' কাঠের জেটিতে নামতে হলো। সেখান থেকে পদব্রজে প্রায় এক কিলোমিটার যেতে হবে চূনাপাথরের গুহা পর্যন্ত। আমাদের সাথে নৌকার একজন লোক যাচ্ছেন আমাদের সেখানে সবকিছু দেখিয়ে দেওয়ার জন্য অর্থাৎ এককথায় সেই আমাদের গাইড। জেটিতে নামার পরে অবশ্য অপেক্ষাকৃত শক্ত মাটি। পথের দু'পাশে সুন্দরী, গরান গাছের জঙ্গল, কোথাও জলের উপরে বাঁশের সাঁকো বেরোতে হলো। কোথাও কোথাও ম্যানগ্রোভের গাছগুলি জলের উপরে তাদের মাথা গুলি আন্দোলিত করে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। এই পথের পরে সবুজ মাঠ ও আদিবাসীদের গ্রাম। এই গ্রামগুলিতে পুনর্বাসন প্রাপ্ত সমতলভূমির ছোটনাগপুরের আদিবাসী শ্রমিকরা বাস করেন। চুনাপাথরের গুহায় প্রবেশের পূর্বে বারাটাং দ্বীপ সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে নিচ্ছি।
বারাতাং দ্বীপের দৈর্ঘ্য ২৭.৮ কিলোমিটার প্রস্থ ১৪ কিলোমিটার। রঙ্গত তালুকে অবস্থিত বারাটাং দ্বীপে মোট ১২ টি গ্রাম আছে তন্মধ্যে বৃহত্তম জনবসতি নীলাম্বর গ্রামে যার নামে নীলাম্বর জেটি। সেখানের জনসংখ্যা ১৬০০ এবং বারাটাং দ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫৭০০। ১৯১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী সবথেকে উল্লেখযোগ্য এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো দ্বীপের জনবসতির সাক্ষরতার হার শতকরা একশ। বারাটাং দ্বীপের উত্তরে মধ্য আন্দামান এবং দক্ষিণে দক্ষিণ আন্দামান। দ্বীপটির বৈশিষ্ট্য হলো সমুদ্রসৈকত, খাঁড়ি, ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, চুনাপাথরের গুহা এবং কাদামাটির আগ্নেয়গিরি। স্থানীয় আদিবাসীরা এই মাটির আগ্নেয়গিরিকে 'জলকি' বলে। বারাটাং দ্বীপ বরাবরই গ্রেট আন্দামানিজদের বাসস্থান ছিল। ১৮৯০ সালের পরে জারোয়ারা এই দ্বীপের দখল নেয় কারণ ততদিনে গ্রেট আন্দামানিজের এই দ্বীপে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছল। এই দ্বীপে পুনর্বাসন পায় বন বিভাগের কর্মীরা এবং রাচিওয়ালার শ্রমিকেরা। দ্বীপের অধিবাসীরা সকলেই মূল ভূখণ্ডের ছোটনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী যার জন্য দ্বীপটিকে রাচিওয়ালা দ্বীপ বলা হয়। উনিশ শতকের শেষ দিকে রাচি শহরে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান হওয়ার ফলে স্থানীয় অধিবাসীরা ইংরেজ মিশনারীদের কাছে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। আন্দামানে উপনিবেশ স্থাপনের সময় ব্রিটিশরা এই সমস্ত আদিবাসীদের শ্রমিক হিসেবে এখানে নিয়ে আসে এবং পরবর্তীকালে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড স্থাপনের সময় তারাই মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের প্রথমদিকে এই সমস্ত জারোয়া অধ্যুষিত অরণ্য ব্রিটিশ প্রশাসন ছিনিয়ে নিয়ে পূনর্বাসনের কাজ পুরোদমে চালায়। সেই শুরুর দিনগুলি জারোয়াদের কাছে বাস্তব পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠোর ও নিষ্ঠুর ছিল। স্বাধীন ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনও জারোয়াদের প্রতি প্রথমদিকে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে। কারণ তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে চলত। শুধুমাত্র সহানুভূতি ছিল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের। তফাৎ শুধু ঔপনিবেশিক যুগের মতো তাদের বিরুদ্ধে মিলিটারি পুলিশের অভিযান ও তাদের কুটীরগুলিতে বোমাবর্ষণ হয়নি। ১৯৩৯ সালে ইংরেজ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ম্যাকার্থির নেতৃত্বে পাঞ্জাব পুলিশ এই বারাটাং দ্বীপে জারোয়া ধরার অভিযান চালিয়ে এক জারোয়া মা এবং তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে ধরে পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে যেয়ে তাদেরকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করে। অবশ্য সেই চেষ্টা সফল হয়নি। বারাটাং দ্বীপটি অতীতের ঐতিহ্য বহন করে আছে। প্রচুর তালিপট পাম গাছ থাকার জন্য গ্রেট আন্দামানিজেরা এই তালিপট পাম গাছকে তাদের ভাষায় বলতো বারাটা এবং সেখান থেকে বারাটাং নামের উৎপত্তি। তাদের বিশ্বাস ছিল এই গাছ পৃথিবী ও মানুষের বিবর্তনের সাথে জড়িত। গ্রেট আন্দামানিজদের অবলুপ্তির পরে জারোয়ারা এই বনাঞ্চলে বহু কুটির বানিয়ে বাস করত। সভ্য মানুষদের বিরুদ্ধে প্রচুর সংগ্রাম করেও এই দ্বীপকে জারোয়ারা রক্ষা করতে পারেনি। বনবিভাগ কর্তৃপক্ষ বুশ পুলিশের সহায়তায় এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে গাছ কেটে উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়াস চালায়। বড় বড় গাছগুলি কেটে সেখানে বনবিভাগ ছোট আকারের গাছ লাগায়, ফলে জঙ্গলের মধ্যে জংলী শূকরের সংখ্যা কমে যায়, যেগুলি দারোয়ানের খাদ্য ছিল। এছাড়াও বহিরাগত মৎস্য ও কুমির শিকারীদের আনাগোনায় বারাটাং দ্বীপ জারোয়াদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। উপনিবেশের মানুষদের সাথে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে তারা এই দ্বীপ ছেড়ে অন্য দ্বীপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। বর্তমানে বারাটাং দ্বীপে যে কয়েকজন জারোয়াদের দেখতে পাওয়া যায় তারা সংখ্যায় অতি নগন্য এবং সভ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে তারা পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে শিখেছে। কিন্তু আদিম জারোয়াদের বেশিরভাগ অংশই পশ্চিম সমুদ্রতটের নিকটস্থ গভীর জঙ্গলে থাকে।
এক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে চুনাপাথরের গুহায় পৌঁছালাম। বিভিন্ন পর্যটকদের মোবাইলের টর্চের আলোতে গুহার ভিতরে সবকিছু অপার্থিব লাগছে। মনে হয় যেন সময় এখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে কোন অতীতে। চুনাপাথরের উপরে জল পড়ে গুহার মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের রূপ যেমনটি দেখেছিলাম অন্ধ্রপ্রদেশের বোরাগুহাতে। মূর্তিগুলি স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাকমাইটের। ঝুলন্ত স্ট্যালাকটাইট, হেলিসাইট এবং মাটি থেকে ওপরে ওঠা স্ট্যালাগমাইট খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট ক্যালসাইট ক্রিস্টালগুলি টর্চের আলোয় হীরক দ্যুতির ন্যায় ঝিকমিক করছে। স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট একসঙ্গে জোড়া লেগে এই ক্যালসাইটের স্তম্ভ গুলি তৈরি হয়েছে। ভেতরটা কোথাও চওড়া, কোথাও আবার সরু। প্রকৃতির আপন খেয়ালে গুহার দেওয়ালে সাদা ও গৈরিক রংয়ের চুনা পাথরের ভাস্কর্যে ফুটে উঠেছে গণেশের মূর্তি, হাতির শুঁড়, ঝুলে থাকা পদ্ম। মনে হয় যেন কোন এক অজানা ভাস্কর লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে থেকে একটির পর একটি ভাস্কর্য আমাদের উপহার দিয়ে চলেছেন। গুহার বাইরে স্থানীয় লোকদের দোকানে লেবু-জল আর নারকেলের প্রাচুর্য। এখানকার নারকেলে জলও যেমন প্রচুর, শাঁসও তেমনই মিষ্টি। আমরা নারকেলের জল ও শাঁস খেয়ে পুনরায় আমাদের নৌকার চালকের সমভিব্যাহারে মেঠোপথ, বাঁশের সাঁকো, ম্যানগ্রোভের জঙ্গল পেরিয়ে আমাদের ছোট নৌকাতে যেয়ে উঠলাম। চুনাপাথরের গুহা দেখে আমরা নীলাম্বর জেটিতে ফিরে আমাদের গাড়ি নিয়ে চললাম 'মাড ভলকানো' দেখতে। এখানে কয়েকটি মৃত মাটি ও কাদার আগ্নেয়গিরি আছে। তন্মধ্যে যেটি আকারে বড় সেখান থেকে ২০০৫ সালে শেষবারের মত কাদামাটি উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল। এখানে দেখতে পেলাম সেই আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে মিথেন গ্যাস, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রোজেনের সাহায্যে মাঝেমাঝে কাদামাটি বুদবুদের আকারে বের হচ্ছে। সমস্ত ক্ষেত্রটি কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা আছে যাতে অসতর্কভাবে কোন পর্যটক সেই আগ্নেয়গিরির দিকে যেতে না পারেন। এখান থেকে আমাদের পথ এবারে মধ্য আন্দামানের কদমতলা জেটি হয়ে রঙ্গত। দূরত্ব প্রায় ৬৩ কিলোমিটার। মাঝখানে আবার একবার সমুদ্রের খাড়ি পেরোতে হল। মহাত্মা গান্ধী জেটিতে যেয়ে পুনরায় যন্ত্রচালিত বড় স্টিমারের উপরে গাড়ি ও মানুষজন তুলে ওপারে উত্তরা জেটিতে যেয়ে পৌছালাম প্রায় আড়াই টার সময়ে। পথিমধ্যে কদমতলা, বকুলতলা পেরিয়ে রঙ্গতে যেয়ে পৌছালাম সন্ধ্যে প্রায় সাড়ে ছটার সময়। রঙ্গত বাজার পেরিয়ে আমাদের আজকের রাত্রি বাস আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পর্যটন দপ্তরের গেস্ট হাউস 'হকস্ বিল নেস্ট'-এ। রঙ্গত বাজারের পরে প্রায় সতেরো কিলোমিটার রাস্তা সমুদ্রের ধার দিয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম আমাদের আজকের রাত্রি নিবাসে। গেস্ট হাউসে আমাদের দেওয়া হল দোতলাতে একটি প্রশস্ত ঘর ও সংলগ্ন বাথরুম। ঘরের ব্যালকনি থেকে পূর্ব দিকে রাস্তার ওপারে ঝাউবন এবং তারপরে সমুদ্র। সমুদ্রের জলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল বলে এবং সারাদিনের ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার জন্য সেদিন আর কোথাও যাওয়া হলো না।
ক্রমশঃ
Please do not enter any spam link in the comment box.