লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
সপ্তদশ পর্ব
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে আমাদের গন্তব্য স্থল দু কিলোমিটার দূরে ধনিয়া নালা। সমুদ্রের খাঁড়িতে ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে প্রায় সাতশো মিটার যাওয়ার পরে সমুদ্রের দেখা পাওয়া গেল। পুরো রাস্তাটায় কাঠের পুল করা আছে। তলায় সমুদ্রের জল, দুপাশে ঘনসবুজ ম্যানগ্রোভ। বিভিন্ন ধরনের শ্বাসমূল, হাতিকান অর্কিড সহ নানা লবণ জলের উদ্ভিদ। গাছপালার ফাঁকে সকালের সূর্য রশ্মি পথটিকে মায়াময় করে তুলেছে। মাঝে মাঝে বসার জন্য ছোট ছোট বিশ্রামাগার আছে। ৭১৫ মিটার লম্বা কাঠের সেতু পেরোবার পরে কাটবার্ট বে সমুদ্র সৈকত। এখানের সমুদ্রসৈকত বিখ্যাত বিরল প্রজাতির অলিভ রিডলে কচ্ছপের ডিম পাড়ার জন্য। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে এই অলিভ রিডলে কচ্ছপগুলি এখানকার সমুদ্রের বেলাভূমিতে এসে ডিম পাড়ার পরে বন বিভাগের কর্মীরা এই ডিমগুলি সংগ্রহ করে প্রজনন কেন্দ্রে পালন করে পরে আবার সমুদ্রে ছেড়ে দেন। কাটবার্ট বে বিচ রঙ্গত থেকে প্রায় আঠারো কিলোমিটার দূরের বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। এখনো এখানে খুব বেশি পর্যটকদের আনাগোনা হয়নি। এখানের সমুদ্রে স্নান করা হয়নি কারণ জলের তলায় ডুবন্ত পাথর আছে বলে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থল আম্বকুঞ্জ সমুদ্র সৈকত। মূল রাস্তা থেকে কিছুটা গ্রামের পথ ধরে যেতে হয়। তীর ভূমিতে যাবার পথে প্রচুর গাছের সমারোহ এবং সৈকতে ও প্রচুর গাছ। শুকনো গাছের গুঁড়ি কেটে পর্যটকদের বসার জায়গা করা আছে। বিনোদনের জন্য দোলনা আছে যেখানে বসে সমুদ্রের নীল জলের শোভা দেখা এক পরম পাওয়া। এখানে সমুদ্রের জলের তলায় পাথর থাকার জন্য স্নানের পক্ষে উপযোগী নয়। এখান থেকে সমুদ্রের ধার দিয়ে আমাদের গাড়ি আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড ধরে ছুটে চলল ৭২ কিলোমিটার দূরের মায়া বন্দরের দিকে। পথে বিলিং গ্রাউন্ড, নিম্বুদেরা পেরিয়ে মায়া বন্দর। আমাদের আজকের গন্তব্য স্থল মায়াবন্দর থেকে আশি কিলোমিটার দূরে দিগলিপুর। পানিঘাটে সমুদ্রের উপরে সেতু পেরিয়ে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথের দু'পাশে গগন স্পর্শী গাছের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দুপুর একটার সময় যেয়ে পৌছালাম দিগলিপুরে। এখানে আজকের রাত্রি যাপন স্যাডেল পিক পাহাড়ের পাদদেশে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পর্যটন দপ্তরের অতিথিশালা 'টার্টল রিসর্ট'-এ। ঘরের সামনে থেকে দক্ষিনে স্যাডেল পিক পাহাড়ের চিরসবুজ গাছ দেখতে পাচ্ছি। দুপুরে এখানে বেশ গরম। একটু পরেই পাহাড়ের পিছনে সূর্যদেব ঢলে পড়তে গাছগুলির রং ধীরে ধীরে কাল হয়ে গেল। বিকেলে আমরা পাহাড়তলীর অতিথিশালা থেকে নিচে নেমে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলাম নীল সমুদ্রের স্নিগ্ধ পরশ পেতে। পশ্চিমে পাহাড় থাকার জন্য সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখার কোন সুযোগ নেই। দূরে দেখা যাচ্ছে রস ও স্মিথ আইল্যান্ডকে। আন্দামানের একমাত্র নদী কালপং স্যাডল পীক পাহাড় থেকে বেরিয়ে ৩৫ কি.মি প্রবাহিত হয়ে এরিয়াল বে-তে যেয়ে সমুদ্রে মিশেছে। এই কালপং নদী থেকে যে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তার দ্বারা সমগ্র দিগলিপুর তহশীলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় এবং কালপং নদী থেকেই পাইপলাইনের সাহায্যে সমগ্র দিগলিপুর অঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহ করা হয়। সমগ্র দিগলিপুর তহশীল কমলালেবু এবং ধান চাষের জন্য বিখ্যাত। আন্দামানের একেবারে উত্তরে অবস্থিত হওয়ার জন্য মায়ানমার নিকটেই। জলপথে সীমান্ত রক্ষার জন্য নৌবাহিনীর একটি বিরাট ঘাঁটি আছে এরিয়াল বে-তে এবং শিবপুরে নৌবাহিনীর যুদ্ধ বিমানের একটি কেন্দ্র আছে।
পরের দিন আমাদের এখান থেকে ফেরার পালা। সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমাদের গন্তব্য স্থল পোর্ট ব্লেয়ার। পাহাড়তলী থেকে নামার সময় ডানদিকে এরিয়াল বে এবং শিবপুরে নৌবাহিনীর ঘাঁটি দেখতে পাচ্ছি। ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই, তাই দূর থেকে দেখতে হল। এরিয়াল বে-তে দেখতে পাচ্ছি নৌবাহিনীর একটি বিরাট যুদ্ধজাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। ফেরার পথে আর কালিপুর সমুদ্রসৈকতে গেলাম না কারণ গতকাল আসার সময় কাটবার্ট বে-তে অলিভ রিডলে কচ্ছপের প্রজনন কেন্দ্র দেখে এসেছিলাম। সময় স্বল্পতার জন্য রস ও স্মিথ আইল্যান্ডে যাওয়া হলো না। কারণ তাহলে ওই গুলি দেখে সঠিক সময়ে পোর্টব্লেয়ারে ফেরা যাবে না। নীলাম্বর জেটিতে বিকেল তিনটার পূর্বে পৌঁছিয়ে জারোয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিকেল তিনটের মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। বিগত দু'দিন ধরে গাড়িতে একটানা ভ্রমন করে বয়সজনিত কারণে আমার সঙ্গিনীও রস ও স্মিথ আইল্যান্ডে যেতে চাইলেন না। পথিমধ্যে বিলিংগ্রাউন্ডে সকালের জলখাবার খেয়ে পুনরায় গাড়িতে ওঠা। রঙ্গতে প্রবেশ করার পূর্বে বাঁদিকে পুনরায় নীলসমুদ্রকে দেখতে দেখতে প্রায় আঠারো কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা পেরোলাম। কদমতলা জেটিতে এসে দক্ষিণ ভারতীয় হোটেলে দুপুরের লাঞ্চ সেরে সমুদ্রের খাঁড়ি পেরিয়ে পুনরায় গাড়ি করে মিডিল স্ট্রেট জেটিতে যেয়ে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর আড়াইটা বেজে গেছে। তিনটের সময় পুনরায় গাড়ির কনভয় ছাড়লো। জারোয়া বনাঞ্চল পেরিয়ে যখন জিরাকাটাং পৌছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা সময় জানিয়ে দিল বিকেল সাড়ে চারটা বেজে গেছে। এখানে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে গরম চা ও বেগুনি খেয়ে নিশ্চিন্তে গাড়িতে চেপে রাত্রি সাড়ে সাতটায় পোর্টব্লেয়ারের এ্যাবারডিন বাজারের 'জয়মাথি' হোটেলে পৌছালাম।
তিন দিন ধরে মধ্য ও উত্তর আন্দামান ঘুরে আমার উপলব্ধি হলো প্রথমদিকে উপনিবেশ করার সময় সরকারি দপ্তরের কর্মচারী, বুশ পুলিশ এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। প্রথমে দক্ষিণ আন্দামান ও মধ্য আন্দামানের দ্বীপগুলির প্রাচীন গভীর জঙ্গল কেটে জমি বের করে প্রত্যেক উদ্বাস্তুকে বসবাসের উপযোগী জমি এবং চাষের জন্য জমি দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। যেখানের ভূমি অনুর্বর বা পাথুরে সেখানে যে সকল উদ্বাস্তুরা থাকতেন তাদের প্রধান জীবিকা ছিল সমুদ্রে মাছ ধরা এবং জঙ্গলে বিভিন্ন বনজদ্রব্য সংগ্রহ করে বিক্রি করা। প্রতিনিয়ত আদিম বনবাসী জারোয়াদের সাথে সংগ্রাম করে তাদের টিকে থাকতে হয়েছে। সবশেষে উত্তর আন্দামানে উদ্বাস্তু উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছে। প্রথমদিকের দিনগুলি অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত যে কষ্টের মধ্যে এই সমস্ত পরিবারগুলিকে দিন কাটাতে হয়েছে তা অবর্ণনীয়। সেই সময় না ছিল উন্নত যোগাযোগ বা পরিবহনের ব্যবস্থা, বিজলিবাতি, স্বাস্থ্য পরিষেবা। উপরন্তু জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে জারোয়াদের প্রতিনিয়ত আক্রমণ। যে জঙ্গল ছিল জারোয়াদের যুগ যুগ ধরে বিচরণক্ষেত্র সেখানে জঙ্গল কেটে সভ্য মানুষের বসবাসের ব্যবস্থাকে তারা খোলা মনে মেনে নিতে পারেনি। তাদের অস্তিত্বের বিপন্নতা অনুভব করে এই সমস্ত বনচারী আদিম মানুষেরা পুনর্বাসন প্রাপ্ত মানুষদের বসতি গুলি আক্রমণ করে ত্রাসের সঞ্চার করতো। সমস্ত বাধা বিপত্তি তুচ্ছ করে আজ সেই সমস্ত শরণার্থীরা সগর্বে মাথা তুলে বসবাস করছেন দেখে আমাদেরও খুব ভালো লাগলো।
ক্রমশঃ
Please do not enter any spam link in the comment box.