সবুজ দ্বীপ আন্দামান (অষ্টাদশ পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

অষ্টাদশ পর্ব

          গতকাল রাত্রিতে ভালো ঘুম হয়েছে। আজ সকালে আমরা আটটায় হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম পোর্টব্লেয়ার থেকে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে দক্ষিণ আন্দামানের পশ্চিমে ওয়ান্ডুর। গাড়ী এখানে ড্রাইভার পার্কিং লটে রেখে দিল। আমরা ওয়ান্ডুর জেটিতে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় উদ্যান দর্শনের উদ্দেশ্যে লঞ্চে যাওয়ার জন্য টিকিট কেটে লঞ্চে যেয়ে উঠলাম। পনেরোটি দ্বীপ নিয়ে গড়া মহাত্মা গান্ধী জাতীয় উদ্যান। সবগুলি দ্বীপই জনমানবহীন। পর্যটকদের দেখার জন্য দু'টি দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয় - জলিবয় এবং রেডস্কিন দ্বীপে। জলিবয় দ্বীপ খোলা থাকে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত। বর্ষার সময়ে জলিবয় দ্বীপ জলে ডুবে যায়। সেই সময়ে রেডস্কিন দ্বীপে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয়। নীল সমুদ্রের বুকে পনেরটি দ্বীপ গোলকধাঁধার মত। লঞ্চ আমাদের নিয়ে গেল জলি বয় দ্বীপে। স্থলভূমির মানুষের কাছে আশ্চর্য হলেও সত্য যে জলিবয় দ্বীপ সম্পূর্ণ প্লাস্টিক বর্জিত এক ইকো ফ্রেন্ডলি দ্বীপ। এখানে কাঁচ দিয়ে ঘেরা বোটে চেপে সমুদ্রের স্বচ্ছ জলের সামুদ্রিক প্রবাল এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী দেখা এক বিশেষ আকর্ষণ যদিও আমরা ইতিপূর্বে নর্থ বে আইল্যান্ডে যাবার পথে জলতলের সমুদ্রের প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, তথাপি এখানেও পুনরায় এই গ্লাস বোটে আমরা জলের তলার জগৎকে পুনরায় দেখার জন্য গেলাম। জলিবয়ের সমুদ্রতটে সাদা রংয়ের বালি। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবাল দ্বীপ এই জলিবয়। জলের নিচে প্রবালের বিভিন্ন প্রকারের সমারোহ - বোল্ডার প্রবাল, ফিঙ্গার প্রবাল, কলিফ্লাওয়ার প্রবাল; কত না বাহারী নাম, বোটের মাঝিরা বলে দিতে জানলাম। বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, যেমন জেব্রা, প্যারট, ক্লাউন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও গাছের মতো দেখতে সমুদ্র লিলি এবং সি কিউ কাম্বার জাতীয় বিশেষ ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী এখানে দেখা গেল। এই দ্বীপে যেতে গেলে পানীয় জল সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয় কারণ দ্বীপের মধ্যে কোথাও পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। শুকনো খাবার নিয়ে গেলে খাবারের প্লাস্টিকের প্যাকেট গুলি ব্যাগের মধ্যে করে পুনরায় পোর্ট ব্লেয়ারে নিয়ে আসতে হবে। সমুদ্র তীরে কোন প্লাস্টিক ফেললে জরিমানা দিতে হয়। জলিবয় দ্বীপ থেকে দুপুর সাড়ে বারোটায় বেরিয়ে আসার পথে অনেকগুলি চিরসবুজ বনাঞ্চল সমৃদ্ধ দ্বীপের পাশ দিয়ে নীল সমুদ্রে ভেসে ওয়ান্ডুর জেটিতে এসে পৌছালাম দুপুর দেড়টায়। এখানেই হোটেলে লাঞ্চ করে আমরা মুন্ডা পাহাড় বীচে এলাম দুপুর তিনটেয়। বিস্তীর্ণ সমুদ্রতীরে ভালোভাবে বেড়ানো যায় এবং সমুদ্রে স্নান করাও যায়, কিন্তু জলে বেশী দূর যেয়ে সাঁতার কাটা বিপজ্জনক কারণ জলের তলায় বড় বড় পাথর ছড়িয়ে আছে। সমুদ্রের তীরে মুণ্ডা পাহাড়। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দু'কিলোমিটার ট্রেক করে পাহাড়ে ওঠা যায়। এখান থেকে আমরা এলাম চিড়িয়াতাপু বীচে। পাখিদের স্বর্গরাজ্য এই বীচটি। গাছে গাছে অসংখ্য পাখি দেখতে পেলাম। অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে ভরা বলেই মনে হয় নাম হয়েছে চিড়িয়াতাপু। হিন্দিতে পাখীকে চিড়িয়া বলে। বেলাভূমিতে শুকনো ম্যানগ্রোভ ও অন্যান্য গাছের ডালগুলিকে আকার দিয়ে বসার জায়গা করা আছে। এছাড়াও শুকনো গাছের ডালগুলিকে আকার দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমার পাখি বা অন্যান্য মূর্তিগুলি পর্যটকদের যথেষ্ট আনন্দ দেয়। সমুদ্রের জলে প্রবাল ও রঙবেরঙের মাছ এবং সামুদ্রিক প্রাণীর স্বর্গরাজ্য। ছুটির দিনে বহু লোক পোর্ট ব্লেয়ার থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে এসে সমুদ্রে স্নান করে পাখিদের গান শুনতে শুনতে খাবার খেয়ে এখানকার অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখে বাড়ি ফিরে যান। এখান থেকে আমরা সানসেট পয়েন্ট এলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সূর্যদেবতা উজ্জ্বল রুম থেকে ধীরে ধীরে ডিমের কুসুম বর্ণ ধারণ করে সিঁদুরে রঞ্জিত হয়ে এক সময় সমুদ্রের জলে ডুব দিয়ে চারিদিক অন্ধকার করে দিলেন অবশ্য কিছুক্ষণ পরে শুক্লপক্ষে চাঁদের উদয় হলো। এখানের পথিপার্শ্বস্থ দোকানের চা বিস্কুট খেয়ে আমরাও ফিরে চললাম আমাদের হোটেলে। একটানা কয়েকদিন ঘোরার পরে বয়স জনিত কারণে আমাদের খুব ক্লান্ত লাগছে। আগামীকাল আমাদের যাওয়া নির্ধারিত আছে চাথাম 'স' মিল, সিপ্পিঘাটের ঔষধি বাগান, সামুদ্রিকা, নৃতত্ত্ব বিভাগের মিউজিয়াম এবং করবাইনস্ কোভ বীচ দেখতে যাওয়ার।

          পরের দিন আমরা সকাল সাড়ে আটটায় হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম ওয়ান্ডুরের পথে পনেরো কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সিপ্পিঘাট কৃষি ফার্মে। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান। ৮০ একর পরিমিত জায়গার উপরে বিভিন্ন মসলা, ঔষধি এবং কফির চারা প্রস্তুত করে, বড় গাছগুলির পরিচর্যা করে ফুল, ফল ও বীজের থেকে বিভিন্ন ঔষধের উপকরণ, মসলা ও কফি ভারতের আভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি করা হয় এবং ভারতের বাইরেও রপ্তানি করা হয়। সকাল ন'টায় কৃষি ফার্ম খোলা হয়। এখানে আমরা লবঙ্গ এবং এলাচের চারা কিনলাম। আগামীকাল আমাদের ফিরে যাওয়া হবে, সেইজন্য চারাগুলি কিনলাম যাতে আমাদের ওখানের আবহাওয়াতে চারাগুলি বাঁচিয়ে রাখতে পারি। কৃষি ফার্মের আরেকটি আকর্ষণ বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি, যেগুলি এসেছে হিমালয়ের ওপারের সুদূর সাইবেরিয়া বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে। এখানে এক ঘন্টা কাটিয়ে আমরা জংলিঘাট পেরিয়ে চললাম এশিয়ার বৃহত্তম ও প্রাচীন কাঠ চেরাই কল চাথাম 'স' মিল দেখতে। ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশদের হাতে গড়া এই কাঠ চেরাই কলটি। সমুদ্রের বুকে চাথাম সেতু পেরিয়ে চাথামে পৌঁছে প্রথম দর্শনে দেখতে পেলাম বিরাট বিরাট কাঠের গুঁড়িগুলিকে যেখানে বিভিন্ন আয়তনে চেরাই করা হচ্ছে। প্রথমে আন্দামানের জঙ্গল থেকে বিরাট আকারের যে গুঁড়িগুলি সমুদ্রপথে আনা হয় সেগুলিকে জাহাজ থেকে নামিয়ে গুদামজাত করা হয়। সেখান থেকে গুঁড়িগুলি যন্ত্রের সাহায্যে কাঠ চেরাই কলে নিয়ে এসে বিভিন্ন আয়তনে চেরাই করা হচ্ছে। এই চেরাই করা বড় গুঁড়িগুলি পুনরায় অন্য একটি যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন মাপে চেরাই করার পরে কারখানার অন্য একটি অংশে পাঠিয়ে বিভিন্ন শিল্পজাত দ্রব্য ও মডেল তৈরি করে বিক্রয়ের জন্য এখানের বিক্রয় কেন্দ্রে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। দেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী কাঠগুলিকে চেরাই করে পুনরায় সমুদ্রপথে বাজারজাত করা হয়। এখান থেকে দূরে হাড্ডো জেটিতে দেখতে পাচ্ছি একটি বিরাট আয়তনের জাহাজকে। কাঠ চেরাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা বনবিভাগের মিউজিয়াম প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্রে গেলাম ২০০৬ সালে এই মিউজিয়ামটি বনদপ্তর থেকে স্থাপন করা হয়েছে। বিরাট আয়তনের একটি ঘরে কাঠের তৈরি বিভিন্ন মূর্তি, চেয়ার-টেবিল, সোফা সেট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস সাজানো আছে এবং প্রত্যেক দ্রব্যের দাম লেখা আছে সম্ভাব্য ক্রেতার সুবিধার্থে। এই জিনিসগুলি আন্দামানের জঙ্গলের চন্দন, পাদুক, গর্জন প্রভৃতি মূল্যবান কাঠ দিয়ে তৈরি। আমরা একটি গণেশ মূর্তি 'শোপিস' আন্দামানের স্মারক হিসেবে কিনলাম। এছাড়াও মিউজিয়ামের দেওয়ালে বিভিন্ন ফটোর সাহায্যে আন্দামানের ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি, জঙ্গল থেকে হাতির সাহায্যে কিভাবে বিরাট আকারের কাঠের গুঁড়ি গুলি সমুদ্রের ধারে আনা হয় এবং সেখান থেকে জলযানের সাহায্যে কাঠ চেরাই কলে আনা হয় সেগুলি দেখে আমাদের একটি সম্যক ধারণা উপলব্ধি হলো। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে ব্রিটিশ শাসনাধীনে আন্দামানের মহামূল্যবান পাদুক কাঠ দিয়ে ইংল্যান্ডেশ্বরীর বাকিংহাম রাজপ্রাসাদের আভ্যন্তরীণ দেয়ালের উপরে কাঠের অলংকরণ করা হয়েছিল। জাপানীদের হাত থেকে আন্দামান পুনরুদ্ধারের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এখানে ব্রিটিশ বাহিনীর বোমা নিক্ষেপের ফলে যে বিরাট গর্ত তৈরি হয়েছিল সেটি বর্তমানে জল দিয়ে ভর্তি করা আছে। সেটি দেখার সুযোগ হলো। এর পাশেই জাপানিদের নির্মিত বাঙ্কারটি দেখারও সুযোগ হলো। চাথাম স মিল থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থল হাড্ডো রোডের আন্দামান টিল হাউসের নিকটে সাবমেরিন মিউজিয়াম কিন্তু তার পূর্বে দুপুরের লাঞ্চ করলাম এখানে একটি হোটেলে। ভারতীয় নৌবাহিনীর দ্বারা স্থাপিত এই মিউজিয়ামে আন্দামানের সামুদ্রিক প্রাণী জগৎ পরিবেশ রক্ষা জীবজন্তু গাছপালা আদিম অধিবাসীদের জীবনযাত্রার বিস্তৃত বর্ণনা লেখা ও মডেলের সাহায্যে রাখা আছে।

ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !