সবুজ দ্বীপ আন্দামান (দ্বাবিংশ পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

দ্বাবিংশ পর্ব

          খেলাধুলা ও অবসর বিনোদন: জারোয়ারা অবসর সময়ে নাচেও গানে মেতে উঠে। যেদিন ভালো শিকার হয় সেদিন তারা একসাথে ভোজন করে খুশিতে গান গাইতে থাকে, বিশেষত জংলি শুকর শিকার হলে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়। তাদের প্রিয় কোরাসগান 'ওলে লে লে লে ওলে লো'। আজকাল লোকালয়ের সংস্পর্শে আসার পরে জারোয়া শিশুরা হিন্দি ফিল্মের গান ও নাচ শিখেছে। তাদের শরীর নমনীয় যার ফলে নাচতে কোনো অসুবিধা হয় না। জারোয়া শিশুরা জঙ্গলের গাছে বেতের দড়ি বেঁধে দোল খেয়ে কুটিরে সময় কাটায়। জঙ্গলের মধ্যে লুকোচুরি খেলে। নবদম্পতির লুকোচুরি খেলা দেখতে খুবই সুন্দর। সাঁতার কাটাও তাদের কাছে এক রকমের খেলা এবং এতে তারা আনন্দ লাভ করে। একসঙ্গে অনেক জারোয়া শিশু সমুদ্রের অল্প জলে সাঁতার দেয়। ডুবসাঁতার তাদের খুব প্রিয়। জারোয়া তরুণেরা শরীরের বিভিন্ন ভঙ্গিমা দেখিয়ে নানা রকমের খেলা দেখায়,অনেকটা সার্কাসের মতো, যা তাদের কাছে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। উপরে হাত দিয়ে হাঁটে, মাঝে মাঝে এই অবস্থায় নাচতে থাকে। এই নাচকে বলে থিপ-থিপ। আবার পা ওপরে রেখে মাটিতে মাথা রেখে হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে তারা আসন করে অথবা একটা হাতের উপর ভর দিয়ে শরীরকে শূন্যে ভাসিয়ে দেয়। একজনের কাঁধের উপর আরেকজন, তার কাঁধের উপর আর একজন দাঁড়িয়ে জিমন্যাস্টিকের খেলা দেখায়। এছাড়াও জারোয়া যুবকেরা কাঁধে-পিঠে কোমরের দুই পাশ থেকে দুজনকে ধরে তারা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বাহাদুরি দেখায়। লোকালয়ের মানুষের কাছে তারা এখন ফুটবল-ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলা শিখেছে। আদিম জনজাতি জারোয়াদের কণ্ঠস্বর খুবই মিষ্টি, কোন কর্কশতা নেই যা তাদের কাছে প্রকৃতির দান। গান করার সময় তারা তালের দিকে নজর রাখে। গানের তালে তালে নাচ করে। তাদের লোকনৃত্য দুচোখ ভরে দেখার মত। জারোয়া তরুণ-তরুণীরা বনফুলের মালা ও লতাপাতা দিয়ে সেজে আরণ্যক জীবনের সম্পৃক্ত নানা রকমের লোকনৃত্য করে। হাতে হাত ধরে যখন সকলে নাচে তখন দেখতে খুব সুন্দর লাগে। পুরুষেরাও সাজগোজ করে নাচ করে। স্বামী স্ত্রী একসাথে গানের তালে তালে নাচ করে খুশির মেজাজে মত্ত হয়।

          জারোয়াদের বিভিন্ন হস্তশিল্প: যে সমস্ত হস্তশিল্পগুলি জারোয়ারা মেহনত করে তৈরী করে তার সমস্ত উপকরণ তাদের অরণ্য থেকে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রকম গাছের ডাল ও পাতা থেকে এবং লোহা, পাথর ও সমুদ্রের কড়ি থেকে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরী করে। যে সমস্ত অরণ্য সম্পদ তারা ব্যবহার করে তাদের স্থানীয় নাম ও ব্যবহার প্রণালী নিচে উল্লেখ করলাম।

ধানিপাতি ও সেলাইপাতি - কুটীরের আচ্ছাদনের জন্য এই গাছের পাতা ব্যবহার করে।

থাঙ্কোবাজেটা - জঙ্গলে মৌমাছির চাক ভাঙ্গার সময়ে মৌমাছি তাড়ানোর জন্য এই গাছের পাতা ব্যাবহার করে।

জংলী হলদি - এই গাছের লতা ও পাতার রস মেখে জারোয়ারা মৌচাক পেড়ে আনে।

নেওয়া - এই গাছের রস মেখে ও সরু কান্ড দিয়ে জারোয়ারা মৌমাছি তাড়ায়।

মাকচুন - জারোয়া নারীরা ঋতুমতী হওয়ার সময় এই গাছের পাতা ব্যাবহার করে।

বাঁশ- তীরের দণ্ড তৈরী করে।

ছিলোকা - এই গাছের ছাল জারোয়াদের শিকারের বর্ম ও দড়ি বানাতে লাগে। এছাড়াও লালবম্বে নামে এক প্রকার গাছের ছাল দিয়েও বর্ম বানায়।

মোটা, পেনসিল ও জংলী বেত - কুটির তৈরী করার জন্য ব্যাবহার করে।

কদম ও ঝিঙ্গাম - গাছের কান্ড দিয়ে মধু রাখার পাত্র বানায়।

গর্জন - গাছের ডাল-পালা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে।

লম্বাপাতি - এই গাছের পাতা শুকর মাংস সিদ্ধ করতে ব্যাবহার করে।

টুংকাপো - এই গাছের লতা দিয়ে গাঁড় মারা ধনুকের দড়ি তৈরি করে এবং চুঁই কাঠ দিয়ে ধনুক বানায়।

          জারোয়া মহিলারা বেত গাছের ডাল ও লতা দিয়ে ঝুড়ি তৈরী করে। জারোয়া পুরুষেরা লোহাকে পিটিয়ে তীরের ফলা বানায়। যখন লোহার প্রচলন ছিল না তখন তারা জংলী সুপারি গাছের শক্ত ও পুরু ছাল দিয়ে তীরের ফলা বানিয়ে তীরের সাথে ছিলোকা গাছের ছাল থেকে তৈরি দড়ি দিয়ে মজবুত করে বাঁধত। এই সুপারি গাছের ছালের তীর লোহার তীরের মত সমান উপযোগী। এছাড়াও সমুদ্রের কড়ি ও পাথর থেকে তারা তীরের ফলা বানাত। সমুদ্র থেকে পাওয়া বড় কড়ি থেকে ছুরির ব্যবহার আজও আছে যেগুলি লোহার ছুরির মতো ধারালো। প্রস্তর যুগে পড়ে থাকা আদিম মানুষদের একদিনের ভরসা ছিল এই সমস্ত কড়ি ও পাথরের অস্ত্র।বহু যুগ পরে লোহার তীরের ফলা তারা ব্যাবহার করতে শুরু করে।সমুদ্রের জলে ভেসে আসা ভগ্ন জাহাজের লোহা থেকে তারা তীরের ফলা বানানো শুরু করে। ১৯৭৪ সাল থেকে আন্দামান ও নিকোবর প্রশাসনের জনজাতি বিভাগ থেকে তাদের লোহার রড উপহার সামগ্রী হিসেবে দিতে থাকে সেই রডকে পিটিয়ে তারা তীরের ফলা ও ছুরি বানায়। লোহাকে গরম করে বার না করেও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তারা এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বানায় এবং লোহা কাটতে ছেনি ও হাতুড়ির ব্যবহার করে। সমুদ্রতটের পাথরে বারবার ধার দিয়ে তীরের ফলা ও ছুরি গুলিকে ধারালো করে তোলে। জল রাখার পাত্র বাঁশের চোঙ দিয়ে বানায়। আজকাল সমুদ্রে ভেসে আসা প্লাস্টিকের বোতলেও জল রাখে। মধু রাখার পাত্রকে তারা 'উহু' বলে। ঝিঙ্গাম ও কদম গাছের বড় কান্ড থেকে একদিক আস্ত রেখে অপর দিক থেকে কাঠকে কুরে কুরে ফেলে দিয়ে ঠিক একটা ডেকচির আকার নিয়ে আসে। এই পাত্রে মধুর চাক আস্ত রাখা যায়। শিকারের বর্ম (কেকার্ড), মধু রাখার পাত্র, তীরের দন্ড প্রভৃতিকে লাল লতার রস অথবা শূকরের রক্ত দিয়ে বিভিন্ন নকশা করে তারা সাজিয়ে রাখে। জারোয়ারা মাটির বাসন তৈরি করতে জানেনা। গ্রেট আন্দামানিজদের মধ্যে অবশ্য অতীতে মাটির বাসনের ব্যবহার ছিল। বর্তমানে প্রশাসনের দেওয়া অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিগুলি ও লোকালয়ের থেকে চুরি করে আনা থালা-বাসন তারা অনেকেই ব্যাবহার করে।

ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !