সবুজ দ্বীপ আন্দামান (ত্রয়োবিংশ পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ত্রয়োবিংশ পর্ব

          আদিম মানুষদের প্রথাগত চিকিৎসা বিদ্যা: আজ পর্যন্ত নেগ্রিটো জারোয়াদের প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতির অল্পই আবিষ্কার করা গেছে। তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই বেশি। ভয়াবহ হেপাটাইটিস- বি ভাইরাস যদিও তাদের মধ্যে প্রতি দুজনের এক জনের শরীরে পজিটিভ তথাপি তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এই তথ্য বিস্ময়কর। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোন অংশ, হাত বা পায়ের হাড় ভেঙে গেলে তারা উপযুক্ত সাইজের কাঠের তক্তা বা বাঁশের পাতি ভাঙ্গা অংশের উপরে লতা দিয়ে ভালো করে বেঁধে দেয়। কোন জায়গায় ক্ষত হলে বিভিন্ন লতা পাতার রস লাগিয়ে বন্ধ করে। যদি বিষাক্ত হয়ে জীবন সংশয় হবার উপক্রম হয় তাহলে ধারালো ছুরি বা দা দিয়ে সেই অংশটা কেটে তারা লতা পাতার রস দিয়ে বেঁধে দেয়। ভঙ্গুর লাল পাথুরে মাটিকে পুড়িয়ে তারা এক রকমের পাউডার বানায়। তার সাথে বন্য শূকরের চর্বির তেল মিশিয়ে জারোয়া ভাষায় 'আলাম' নামে একপ্রকারের বেদনানাশক পেস্ট বানায়। শরীরের কোন অংশে ব্যথা অনুভব করলে সেখানে এই আলাম লাগিয়ে তারা প্রলেপ দেয়। উদরাময় রোগ হলে দেখা গেছে তারা সমুদ্রতট এলাকায় প্রাপ্ত হালকা বাদামী রঙের একরকম মাটিকে শুকনো করে চিবিয়ে খেয়ে নেয়। সর্দি বা কাশি হলে জারোয়ারা জঙ্গলে প্রাপ্ত 'এনতাও' লতার কাণ্ডকে চিবিয়ে তার রস খায় এবং জঙ্গলে প্রাপ্ত মধু ব্যবহার করে। এছাড়াও বার্ধক্যজনিত অবসন্নতা এবং জড়তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তারা মধু খেয়ে থাকে। পেটে ব্যথা হলে লতা পাতা সহ ছোট ডাল দিয়ে বারবার রোগীর পেটে ঝাপটা মারে। কারো মাথা বা শরীরের কোন জায়গায় ব্যথা হলে তার নিকটজন পা দিয়ে সেই জায়গাটি ডলে দেয়। সন্তান প্রসবের পরে তলপেট, মাথা ও বুকের ব্যথা কমানোর জন্য অনেকগুলি লতা ব্যথার স্থানে শক্ত করে বেঁধে দেয়। সন্তান প্রসবের সময় তাদের মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের কোন রকম অবনতি হয় না। নবজাতক শিশুর নাভি সংক্রমণও দেখা যায় না। গর্ভবতী মহিলা বা সদ্য সন্তান প্রসবা মায়ের রক্তহীনতা রোগলক্ষন দেখা যায় না। সন্তানসম্ভবা নারীকে জারোয়া নারীরাই সন্তান প্রসব করায়। পুরুষেরাও সন্তান প্রসব দক্ষতার সঙ্গে করে। সদ্যপ্রসূত শিশুর নাভিরজ্জু পরিষ্কার ছুরি দিয়ে কাটার পরে নাভি রজ্জুতেই গিঁট বেঁধে দেয়। নাভি রজ্জু বাঁধতে কোন সূতোর ব্যবহার করেনা। কাটা নাভিরজ্জুর মুখ থেকে যে রক্তপাত হয় তাকে বন্ধ করার জন্য তারা 'অরো' নামক একপ্রকার লতার পাতা গরম করে তার রস বার বার নাভির মুখে লাগায় এবং তাতেই রক্তপাত থেমে যায়। এই 'অরো'কে আমাদের ভাষায় জংলি জায়ফল গাছ বলে। সদ্য সন্তান প্রসব করা মা আগুনের সামনে বসে থাকে এবং কিছুটা মধু খেয়ে তার ক্লান্তি দূর করে। জারোয়া মহিলারা ঋতুকালে কোথাও বসার আগে কিছু পরিষ্কার লতাপাতা সেখানে পেতে তার উপরে বসে। ঋতুস্রাব শুষে নেওয়ার জন্য জঙ্গলের এক প্রকারের লতা শুকনো অবস্থায় অথবা তাজা লতা যোনি মুখে বেঁধে রাখে এবং তাতেই ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। সন্তান প্রসবের পরেও একই পদ্ধতিতে তারা রক্তপাত বন্ধ করে। জারোয়া নারীরা সন্তান প্রসবের পরে বহুদিন পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ায়। নবজাতক পুরুষ শিশুর ফাইমোসিস জনিত সমস্যার সমাধান তারা এক বিশেষ পদ্ধতিতে করে। এক মাসের মধ্যে পুংলিঙ্গের অগ্রভাগের চামড়াকে জারোয়া বয়স্ক মহিলারা হাতের আঙ্গুলের পরিষ্কার নখ দিয়ে চিরে চামড়াকে পিছনে ঠেলে দেয়। খুব কম ক্ষেত্রেই প্রথাগত এই বিশেষ  চিকিৎসায় ক্ষত জীবাণু দুষ্ট হয়। মশার কামড়ে হাত পা লাল হয়ে গেলে এবং অসম্ভব চুলকানি হলে জঙ্গল থেকে তারা 'তিদাংওয়ে' নামে এক প্রকার লতার রস লাগিয়ে নিলে সুস্থ হয়ে যায়। আদিম জনজাতি জারোয়াদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত ব্যাধি নেই কেবলমাত্র সংক্রমণ জনিত সমস্যায় মাঝেমাঝে পুষ্টির অভাব দেখা গেছে। জারোয়া পুরুষ বা নারীর মধ্যে কোন রকম যৌন রোগ নেই। তাদের মধ্যে কোন পুরুষ বা নারীর বহুমূত্র রোগ নেই এবং তাদের রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক। জারোয়াদের মধ্যে নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। বেশিরভাগ দম্পতি বেশী সন্তান কামনা করে এবং তাদের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার খুব কম। যার ফলে একটি আশার আলো, যেখানে অন্যান্য আদিম জনজাতিরা কালের স্রোতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বা হবার উপক্রম সেখানে জারোয়াদের জনসংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

          জারোয়াদের বিবাহ প্রথা: গ্রেট আন্দামানিজদের মতো জারোয়ারাও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে। স্ত্রী মারা গেলে জারোয়া পুরুষ পুনরায় বিয়ে করে এবং স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা মহিলাদেরও বিয়ে করার সামাজিক অধিকার আছে। যার ফলে তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর বন্ধন দৃঢ়। নিজের ভাই বোন বা খুব কাছাকাছি রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে হয়না। খুব অল্প বয়সেই জারোয়াদের বিয়ে হয় স্বাভাবিক নিয়মে। বিয়ের সময় ছেলের বয়স মেয়ের বয়সের থেকে বেশি হয়। বিয়ের আগে তাদের মধ্যে বাগদান হওয়ার কথা আছে এবং বাগদান হওয়ার পরে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে অবাধ মেলামেশায় সমাজের সম্মতি থাকে। বাগদানের পরে যৌনমিলনকে তারা স্বাভাবিকভাবেই দেখে। অবশ্য জারোয়া সমাজেও উচ্ছৃংখল জীবনযাপনের দৃষ্টান্ত আছে। বিধবা মহিলা বা অবিবাহিতা তরুনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটে থাকে, তবে কখনো কোন বিবাহিত স্ত্রীর অপর পুরুষের সাথে যৌনমিলনের ঘটনা নেই। জারোয়ারা অবৈধ ধর্ষণকে যদিও ঘৃনার চোখে দেখে তথাপি ধর্ষিতা নারীর মধ্যে মানসিক ক্ষত খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়। বারো থেকে পনেরো বছর বয়সের মধ্যে জারোয়া তরুণ-তরুণীদের বাগদান পর্ব শেষ হয়। এই বাগদান পর্বকে জারোয়া ভাষায় 'আটিয়াপিছে' বলা হয়। বাগদানের পর সমাজের স্বীকৃতি লাভ করে তারা অবাধ মেলামেশায় পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। একটি তরুণ বা তরুণী সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তার বাগদান পর্ব হয়না। সাবালকত্বের প্রমাণ স্বরূপ তরুণকে জঙ্গলে যেয়ে নিজের হাতে এক তীরের সাহায্যে জংলী শুকর মেরে আনতে হয় এবং তরুণীরা ঋতু প্রাপ্ত হলে তবেই  সাবালিকা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জারোয়া তরুণ-তরুণীরা তাদের জীবনসঙ্গী নিজেরাই সমাজের মধ্য থেকে পছন্দ করে। এরপরে মা বাবা সম্মতি দিলে জারোয়াদের সমাজ তাদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করে। জারোয়াদের বিবাহকে তাদের ভাষায় বলে 'ওয়াঙ্গে'। এই বাগদান বা বিয়ের সময় তারা সাদাটে ও ধূসর রঙের মাটির প্রলেপ দিয়ে মুখে ও গায়ে নকশা করে। বনফুল ও লতাপাতার ব্যান্ড বা রিং বানিয়ে মাথা, গলা ও কোমরে দুজনে বাঁধে। এরপরে ছেলে এক জায়গায় বসে থাকে এবং মেয়েকে নিয়ে যেয়ে ছেলের কোলে বসিয়ে দেওয়া হয় অথবা অনেক ক্ষেত্রে মেয়ে নিজেই এসে ছেলের কোলে বসে। বাগদান বা বিবাহের এই অনুষ্ঠানের পরে জারোয়ারা শিকার করা শুকরকে প্রথাগত পদ্ধতিতে রান্না করে সকলে মিলে খায় ও আনন্দে মেতে ওঠে। তাদের বিয়ে সাধারণত সন্ধ্যাবেলায় হয়। জারোয়া তরুণীরা শিকারি তরুণকেই মনের মত জীবনসঙ্গী বিবেচনা করে। জারোয়া সমাজে অবিবাহিতা ও বিধবা মহিলারা আলাদা কুটিরে থাকে এবং সেখানে কোন পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। বিধবা বিবাহ জারোয়া সমাজে খুবই প্রচলিত। আসলে তাদের জীবন যাপনের রীতিনীতি ও সমাজব্যবস্থা যেরকম তাতে বিধবা বিবাহের প্রয়োজন বেঁচে থাকার তাগিদেই। স্বামী বা স্ত্রীর যেকোনো একজনের মৃত্যু হলে অপরজন পুনরায় বিবাহ করতে পারে এবং দ্বিতীয় বিবাহের পরেও স্বামী বা স্ত্রীর কেউ একজন মারা গেলে অপরজন পুনরায় বিবাহ করতে পারে- এটাই জারোয়া সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত।

ক্রমশঃ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !