লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
দ্বাদশ পর্ব
চতুর্থ দিনে সকাল সাড়ে নটায় সরকারি ফেরি লঞ্চ আমাদের নিয়ে যাবে হ্যাভলক দ্বীপে। ওখানে 'ডলফিন রিসর্টে' একদিন থেকে পরের দিন সকালে নীল দ্বীপে যাওয়া। সেই মতো পোর্ট ব্লেয়ারের ফিনিক্স বে জেটি থেকে নির্ধারিত সময়ের কিছু পরে আমাদের লঞ্চ বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশির উপরে রাজহংসীর মত সাঁতার দিয়ে ডলফিনকে সাথী করে ৪১ সামুদ্রিক নটিক্যাল মাইল পেরিয়ে দুপুর দেড়টায় হ্যাভলক জেটিতে যেয়ে পৌঁছালো। এই প্রসঙ্গে হ্যাভলক দ্বীপ সম্বন্ধে পাঠকের জ্ঞাতার্থে কিছু তথ্য পরিবেশন করছি। স্যার হেনরি হ্যাভলকের নামানুসারে দ্বীপের নাম হয়েছিল হ্যাভলক দ্বীপ। পরবর্তীকালে বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী হ্যাভলক দ্বীপের নাম পরিবর্তন করে স্বরাজ দ্বীপ নামকরণ করেছেন। ৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট দ্বীপটি নারকেল বীথি, গভীর অরণ্য ও কৃষি জমিতে ব্যাপ্ত। দ্বীপটি লম্বায় ১৮ কিলোমিটার এবং চওড়াতে ৮ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুসারে দ্বীপের জনসংখ্যা ৬৩৫১ জন, শিক্ষিতের হার শতকরা ৮৫ জন। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি এবং শীতকালে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০৪ সালের সামুদ্রিক ঝড় সুনামিতে অবশ্য দ্বীপের কোনো ক্ষতি হয়নি। ছটি গ্রাম নিয়ে হ্যাভলক দ্বীপ গঠিত। এগুলি হল: গোবিন্দ নগর, বিজয়নগর, শ্যামনগর, কৃষ্ণনগর এবং রাধানগর। হ্যাভলক দ্বীপ তার সমুদ্র সৈকতের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। এখানের তিনটি উল্লেখযোগ্য সমুদ্র সৈকত হল রাধানগর, এলিফ্যান্ট এবং কালাপাথর। কৃষিজ উৎপাদিত ফসল হলো ধান এবং তৈলবীজ। এছাড়াও এখানে প্রচুর পরিমাণে ডাব, নারকেল, আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, সবেদা, কাজুবাদাম ও কলার চাষ করা হয়। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে সমতল ভূমিতে ফুল ও সবজির চাষ করা হয়। জঙ্গলে বিভিন্ন ঔষধি গাছ দেখা যায় এবং মৌমাছি পালন করা হয়। এক কথায় বলা যায় হ্যাভলক দ্বীপ বসবাসের পক্ষে খুবই সুন্দর। অবশ্য তাঁর পুরো কৃতিত্ব প্রাপ্য এই দ্বীপে পুনর্বাসন প্রাপ্ত বাঙালী শরণার্থীদের। জেটি থেকে একটি অটো করে আমরা ডলফিন রিসর্টে যেয়ে পৌছালাম। আমাদের জন্য যে কটেজটি দেওয়া হয়েছিল সেটি দ্বিতল বিশিষ্ট। নিচের তলায় কোন ঘর নেই। কয়েকটি স্তম্ভের উপরে দ্বিতল কটেজটি অবস্থিত। চারিদিকে বিভিন্ন গাছে আবৃত। কটেজের থেকে সমুদ্রের মোহময়ী রূপ দেখা যাচ্ছিল। জলের রং প্রথমে হালকা নীল তার পরে গাঢ়, এর পরের ধাপে কালো এবং সবশেষে তূঁতে নীল বা পান্না নীল দিকচক্রবালে যেয়ে নীল আকাশের সাথে মিশে গেছে। কটেজ থেকে সামান্য দূরে খাবারের জায়গা বা ডাইনিং হল। দুপুরের খাবার খেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে আমরা অটো করে ১২ কিলোমিটার দূরের রাধানগর সমুদ্র সৈকতে যেয়ে শ্বেতশুভ্র অর্ধবৃত্তাকার বালুকাবেলায় পৌঁছে দেখতে পাচ্ছি অগণিত দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ভীড়। পৃথিবীর সাতটি শ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকতের মধ্যে রাধানগর সমুদ্র সৈকত অন্যতম। সোনালী সৈকত থেকে সিকি মাইল দূর অবধি বঙ্গোপসাগরে কোমর সমান গভীর জল কাঁচের মত স্বচ্ছ, রং হালকা সবুজ। সামনের দিকে জলের নিচে বালুকণা, নুড়ি বা পাথরের ছোট ছোট টুকরো গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সিকি মাইল দূরের সবুজাভ জলের রঙ পরিবর্তিত হয়ে নীল হয়ে দূরে আরও দূরে গভীর সমুদ্রে যেয়ে গাঢ় কালো রঙ। মনে মনে ভাবছি জলেরে এই কালো রঙের জন্যই বুঝিবা আন্দামানকে কালাপানি বলা হত। ঢেউগুলি আস্তে আস্তে বেলাভূমিতে এসে আছড়ে পড়ছে, আর সেইসব ঢেউ ফুঁড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ুক্কু মাছ উঠে এসে রূপোলী ঝিলিক দিয়ে পুনরায় সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থেকে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ সময় সমুদ্রের বিভিন্ন রূপ দেখার পরেই সূর্যদেব আকাশ আর সমুদ্রের দিকচক্রবালে এক মুঠো আবীর ছড়িয়ে পাটে বসলেন। সে যে কি অপূর্ব দৃশ্য আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না, কারণ আমি তো সরস সাহিত্যের ছাত্র নই, আমি নীরস হিসাব শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছি এবং সারা জীবন সেইটি পেশা করে চাকুরী করেছি। অজস্র দর্শনার্থী ক্যামেরা ও মোবাইলে সেই স্বর্গীয় দৃশ্য নিজেদের কাছে ধরে রাখতে আকুল প্রয়াসী হয়ে ক্যামেরা ও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। আমরাও অপটু হাতে কয়েকটি ছবি তুললাম। রাধানগর সমুদ্রসৈকতের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ২০০৪ সালের বিশ্ব বিখ্যাত 'টাইম ম্যাগাজিনে' প্রকাশিত নিবন্ধে রাধানগর সমুদ্র সৈকতকে এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং পৃথিবীর সপ্তম শ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকত বলা হয়েছে। সমুদ্রে স্নান করা যায় স্বচ্ছন্দে। জলের তলায় কোন পাথর বা প্রবাল দ্বীপ নেই। রাধানগর সমুদ্র সৈকতের বাম দিকে গভীর অরণ্য ও নারকেল বীথি এবং দক্ষিনে আদিগন্ত নীল জলের সমারোহ।
রাধানগর সমুদ্র সৈকত থেকে সন্ধ্যের সময় ফিরে এসে স্থানীয় বাজারে গিয়ে দেখলাম এখানকার সব অধিবাসীই পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি শরণার্থী। এঁরা সবাই ১৯৬০ সালের মধ্যে এখানে এসে সরকারিভাবে পুনর্বাসন পেয়েছেন। বেশিরভাগ অধিবাসীরাই কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে যুক্ত। এঁদের দেখে মনে হলো না যে মূল ভূখন্ড থেকে সমুদ্রের বুকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কোন দ্বীপে আছি। ভাষা, আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, গৃহনির্মাণ দেখে মনে হলো আমি বাংলার কোন জনপদে আছি। দুই একজনের সাথে সামান্য সময় কথাবার্তা বলে ফিরে এলাম আমাদের রিসর্টে। ডলফিন রিসর্টের চতুর্দিকের সীমানা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। রাত্রের দিকে ডাইনিং হলে খেয়ে আমরা সীমানার ধার দিয়ে বেড়ানোর একটি রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাচ্ছি সমুদ্রের ঢেউগুলি নিস্তরঙ্গভাবে বেলাভূমিতে গড়িয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে মাঝে মাঝে বসার জায়গা করা আছে এবং চারদিকে বিজলি বাতির ব্যবস্থা আছে। কিছুক্ষণ পদচারণা করার পরে আমরা আমাদের কটেজে ফিরে গেলাম।
ক্রমশঃ
Please do not enter any spam link in the comment box.