লেখিকা: দেবিকা দত্ত
নিজের সাদাকালো জীবনে হালকা রঙের মরীচিকা দেখেছিল অনাবিল। বড্ড শান্ত স্বভাবের ছেলে, মাটির মানুষ বলা যেতে পারে। সাত চরে 'রা' কাটেনা। ছোট থেকে প্রচন্ড শান্ত বলে অনাবিলের মা অনাবিলকে 'শুভ্র' বলে ডাকত 'শুভ্র' অর্থাৎ সাদা। এত শান্ত স্নিগ্ধ হওয়ায় অনাবিলের মা এই নামকরণটি করেন। ছোট থেকে পড়াশোনায় প্রচন্ড মন। খুব মন দিয়ে পড়াশুনা করতো সে, ক্লাসে প্রথম স্থান ছাড়া কখনো দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেনি।যখন সে ক্লাস টুয়েলভ-এ পরে, তখন মেহুল নামের একটি মেয়ের সাথে তার কোচিং-এ পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব থেকে ব্যাপারটা কখন ভালোবাসায় পরিণত হয়, সেটা তারা দুজনের কেউই বুঝতে পারেনি।
এই রকম ভাবেই অনাবিলের জীবন কাটছিল। অনাবিল যখন ইঞ্জিনিয়ারিং সেকেন্ড ইয়ার, তখন তার বাবা মারা যায়। সেই সময় থেকেই অনাবিল জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। তার বাবা মারা যাওয়ার ফলে তাদের পরিবারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। আর্থিক সংকটের কারণে অনাবিলের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের সব দায়িত্ব এসে পরে অনাবিলের ওপর। চাকরির খোঁজে ছেলেটা দিনরাত এক করে ফেলে ছিল, যেখানেই ইন্টারভিউ-এর জন্য ডাক আসত সেখানেই ছুটে যেত। কিন্তু প্রত্যেকবার হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরতো। তবে, মাকে কোনদিনও সে বুঝতে দেয়নি যে, সে মন থেকে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়েছে।
চাকরি না পাওয়া অবস্থায় সে ভোরবেলা খবরের কাগজ বিলি করতো, কখনো কখনো ক্যাটারিং-এর কাজ ও বিভিন্ন ধরনের ডেকোরেটিং-এর কাজ ও করতো সে। এইরকমই এক ব্যস্ততম দিনের মধ্যে হঠাৎ সন্ধ্যের দিকে মেহুল-এর ফোন আসে। অনাবিল প্রথমে মেহুলের কলটা রিসিভ করতে পারে না, অতঃপর দ্বিতীয়বারে মেহুলের ফোনটি সে রিসিভ করে এবং খুব শান্ত গলায় বলে, 'এখন কথা বলার সময় নেই, আমি একটা খুবই জরুরি কাজে ব্যস্ত আছি'। মেহুল কিছু বলতে যাওয়ার আগেই, অনাবিল ফোনটা তাড়াতাড়ি করে কেটে দেয়।
সেই দিনটির পর প্রায় এক মাস হয়ে গেল, মেহুল ও অনাবিল একে অপরের সঙ্গে না দেখা করেছে, না কথা হয়েছে। অনাবিল একদমই সময় দিতে পারত না মেহুলকে, নিজের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে। চাকরির সন্ধান পরিবার ও মায়ের দেখাশোনা করতেই সমস্ত সময় বেরিয়ে যেত। এরপর কয়েক মাস চলে যায়...। অনাবিল চেষ্টা করে মেহুলের সাথে যোগাযোগ করার, কিন্তু ফোন করলেই তার ফোন নেটওয়ার্ক কাভারেজ এরিয়ার বাইরে বলে। অনাবিলের সরল মন ভেবেছিল, 'ও হয়তো দূরে কোথাও ঘুরতে গেছে, তাই যোগাযোগ করতে পারছে না'। আরও এক সপ্তাহ গড়িয়ে যায়, অনাবিল একটি চাকরির ইন্টারভিউতে সিলেক্ট হয়। একটা নামকরা কম্পানি তাকে চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ করে। অনাবিল সর্বপ্রথম কথাটি তার মাকে জানায়। একথা শুনে তার মা তাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে এবং সুখের কান্নায় ফেটে পরে। তিনি গর্ব সহকারে বলেন, 'সত্যি আমি রত্নগর্ভা'। মায়ের মুখের হাসি দেখে অনাবিল একটা অদ্ভুত সুন্দর হাসি হেসে উঠে এবং সেই খবরটি মেহুলকে জানানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কিন্তু, তখনও তার ফোন নট রিচেবল বলে। এভাবেই নতুন অফিসের কর্মব্যস্ততার মধ্যে একমাস কেটে যায়। অনাবিলের চিন্তা আরও দ্বিগুন হয়ে ওঠে। মেহুলের সম্পর্কে সে তার বন্ধুদের দিয়ে খোঁজ নেবার চেষ্টা করে, তাতেও কোনোরকমের খবর পায়না সে।
একদিন হঠাৎই সন্ধ্যেবেলা একটা অচেনা নম্বর থেকে অনাবিলের কাছে ফোন আসে। ফোনটা ধরতেই মেহুলের গলা পেল অনাবিল। শান্তশিষ্ট ছেলেটা কেমন যেন একটু মেজাজ দেখিয়ে বলল, 'এত দিন একটাও ফোন করো নি কেন? কেমন আছো তুমি? তুমি জানো কতবার তোমার ওই পুরোনো নাম্বারে ফোন করেছি? প্রায় সাড়ে তিন মাস পর তুমি ফোন করলে...'। মেহুল একটু থামিয়ে দিয়ে অনাবিলকে বলল, 'তুমি কেমন আছো অনাবিল?' একটু গম্ভীর স্বরে অনাবিল বলল, 'ভালো আছি। তুমি?' অনাবিল আবার বলল, 'কোথায় ছিলে এতদিন? তুমি জানো আমি চাকরি পেয়েছি, প্রথমে খবরটা মাকে বলেছিলাম, ভেবেছিলাম তোমায় সেদিন ফোন করে রবীন্দ্র সরোবরে ডেকে সুখবরটা জানাবো। কিন্তু তোমার নম্বরটা নেটওয়ার্ক অঞ্চলের বাইরে বলছিল। বন্ধুদের থেকে তোমার খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউ আমাকে সে ভাবে কিছু জানায়নি। কোথায় ছিলে এতদিন মেহুল? আমি জানি তোমাকে আমি একদম সময় দিতে পারিনি এ কয় মাস। বাবা মারা যাওয়ার পর বড্ড দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম। একদিন দেখা করো মেহুল, অনেকদিন তোমার হাত ধরে হাঁটি না।' ফোনের ওপাশে মেহুল আর চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। সে অনাবিলকে কাঁদতে কাঁদতে বলল, 'মনে আছে একদিন সন্ধ্যাবেলা তোমায় ফোন করেছিলাম, তুমি ফোনটা রেখে দিলে বললে, ব্যস্ত আছি.. আসলে ঐদিন আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। বাবা ওইদিনই আমাদের বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। এই কথাটা বলার জন্যই তোমাকে ফোন করেছিলাম অনাবিল, সেই ছেলেটির সাথে আমার বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেছে। কাল আমাদের রেজিস্ট্রি। ভালো থেকো তুমি। এইটা বলার জন্যই ফোন করেছি আর ওই ফোনের নম্বরটা পাল্টে দিয়েছি, কারণ ওই নম্বরের সাথে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তুমি চাকরি পেয়েছো শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। ভালো থেকো!' অনাবিল কিছু বলার আগেই মেহুল ফোনটা কেটে দেয়। পরে অনেকবার ওই নম্বরে চেষ্টা করেছে অনাবিল, কিন্তু মেহুল ওই নম্বরটায় অনাবিলকে ব্লক করে দিয়েছে। শান্তশিষ্ট ছেলেটা হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে, কি যে করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মাথায় খালি একটা শব্দ ঘুরছে এইমুহূর্তে, 'সুইসাইড,'। হঠাৎ করে অনাবিলের মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা কেমন যেন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত দুঃখ যেন অনাবিলকে একসাথে আঁকড়ে ধরছে। ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার আগের মুহূর্তে অনাবিল তার মায়ের মুখটা মনে পরে। অনাবিলের মা সব সময় তাকে বলে, 'কোন পরিস্থিতিতে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে নেই, শান্ত মাথায় পরিস্থিতি সঙ্গে লড়াই করতে হয়'। ছেলেটির মাথায় জেদ চেপে গিয়েছে যে, সে তার জীবন শেষ করে ফেলবে আজকে। কিন্তু, সে হঠাৎই ভাবলো, 'সে চলে গেলে তার মায়ের কি হবে? তার এখনও অনেক দায়িত্ব। মেহুল তাকে ছেড়ে চলে গেলেও সে তো শেষ চেষ্টা অন্ততপক্ষে করতে পারত, আমার তো একার দায়িত্ব ছিল না সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখার। সে ভাল থাক কিন্তু, আমায় জীবন যুদ্ধে থেমে গেলে চলবে না। আমাকে এগিয়ে যেতে হবে, লড়াই এখনও বাকি'। এই কথাগুলো যেন অনাবিল নিজের মধ্যে অদ্ভুতভাবে আত্মস্থ করে নিল এইটুকু সময়ের মধ্যে।
মেহুলের বিয়ে হয়ে গেছিল, কিন্তু অনাবিল তার জীবন যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। আজ অনাবিল অনেক সুখী, হয়তো সেই দিন লড়াই থামিয়ে দেয়নি বলেই আজ সে জীবন যুদ্ধে জয়ী। জীবনে যত যুদ্ধই আসুক না কেন লড়াই চালিয়ে যেতে হবেই শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত!
Please do not enter any spam link in the comment box.