সবুজ দ্বীপ আন্দামান (অন্তিম পর্ব)


লেখক: দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

অন্তিম পর্ব

          আদিম জনজাতির কুসংস্কার ও মৃতদেহের সৎকার প্রথা: মৃতের সৎকার প্রথা জারোয়া সমাজে বিচিত্র। গ্রেট আন্দামানিজদের সৎকার প্রথা তুলনামূলকভাবে বেশি বৈজ্ঞানিক। তারা মৃতদেহ কবর দিয়ে সৎকার করে। শিশুদের মৃতদেহ কুটিরের নিচে মাটি খুঁড়ে কবর দেয়। কিন্তু জারোয়াদের সৎকার প্রথা ভিন্ন ধরনের। তারা শিশুদের মৃতদেহ কুটির থেকে অল্প দূরে মাটি খুঁড়ে কবর দেয় কিন্তু বড়দের মৃতদেহ তারা কবর দেয় না। এই কবর দেওয়াকে জারোয়ারা বলে 'ডিউটে'। জারোয়ারা বড়দের মৃতদেহ কুটির থেকে বেশ কিছুটা দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে কোন বড় পুরাতন গাছের নিচে যেয়ে সেই গাছের মোটা দুই শিকড়ের মাঝে যে গহ্বর আছে সেখানে মৃতদেহ শুইয়ে দিয়ে তার উপরে লতাপাতা বিছিয়ে গাছের ডাল ও বড় পাথর চাপা দেয়। মৃতদেহ এইভাবে ঢাকা পড়ে যায়। ভারী কাঠ বা পাথর চাপা দেওয়ার ফলে বন্য পশুরা মৃতদেহের কোন ক্ষতি করতে পারে না। সৎকারের এই পদ্ধতিকে জারোয়ারা বলে 'এটিওটে'। মৃতদেহ সৎকার করার সময় জারোয়ারা শোক পালনের চিহ্ন হিসেবে কপালে ধূসর মাটির প্রলেপ লাগায়, গ্রেট আন্দামানিজেরা কপাল ছাড়াও সারা গায়ে মাটির প্রলেপ লাগিয়ে রাখে। জারোয়ারা কপালের মাটির প্রলেপ কয়েকদিন রাখার পরে ধুয়ে ফেলে কিন্তু গ্রেট আন্দামানিজেরা বেশ কিছুদিন মাটি ধোয়ে না। যে কুটিরের নিকটে এই সৎকার হয় সেখানে তারা তিন চার মাস কেহই আসেনা, এটা তাদের অন্ধবিশ্বাস। অবশ্য বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে এর একটি তাৎপর্য আছে, কারণ তিন চার মাস পর্যন্ত মৃতদেহের দুর্গন্ধ আসতে পারে। তিন চার মাস বা তারও পরে জারোয়ারা সৎকারের সমাপ্তি হিসেবে মৃতের শরীরের হাড়গুলি দিয়ে বিভিন্ন সাইজের গয়না বানিয়ে গলা কোমর ও হাতে বাঁধে। ছোট হাড়গুলি দিয়েই তারা গয়না বানায়। মাথার খুলি ও বড় হাড়গুলি তারা গভীর জঙ্গলে বড় গাছের কোটরে বা কোন গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখে। মৃত প্রিয়জনের হাড়ের গয়না পরা তাদের কাছে গর্বের বিষয়। তাদের অন্ধবিশ্বাস এগুলি পরলে রোগ মুক্তি হয় এবং কোন অশুভ শক্তি তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। হাড়ের গয়নার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে তারা হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের স্মৃতিচারণে বিভোর হয়ে যায় এবং সেই সময় বিন্দু বিন্দু জল প্রস্তর যুগের আদিম মানুষদের চোখে দেখা যায়। সুদূর অতীতে নাবিক, পরিব্রাজকেরা বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় যারা আদিম জনজাতির মানুষদের দেখেছেন বা খুব কাছে এসেছেন তারা বলেছেন আন্দামানের নেগ্রিটো উলঙ্গ মানুষেরা নরখাদক। আসলে তারা কিন্তু মানুষের মাংস খায় না বা নরখাদক নয়। তারা তাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনের হাড়ের তৈরী গয়নাগুলি গয়না পরে থাকাকালীন সভ্য মানুষেরা তাদের দেখে ভাবতেন নেগ্রিটো উলঙ্গ মানুষেরা নরখাদক। তারা মনে নরখাদক এই প্রমান এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। বড়দের সৎকার ও শিশুদের সৎকারের মধ্যে একটু তফাৎ আছে। শিশুদের সৎকার দু'রকমের। মৃত্যু স্বাভাবিক হলে কুটিরের নিকটেই সৎকার করা হয়। আর যেখানে তাদের মনে হয় শিশুর মৃত্যুর মধ্যে কোন অশুভ শক্তি ভর করেছে সেখানে তারা অন্যভাবে সৎকার করে। প্রথমে জারোয়া মা তার মৃত শিশুকে কোন বয়স্কা মহিলারা হাতে তুলে দেওয়ার পরে মা-বাবা শিশুর মুখের দিকে না তাকিয়ে সোজা কুটিরে ফিরে যায়। বয়স্কা মহিলা এরপর মৃত শিশুকে এক বয়স্ক জারোয়ার হাতে তুলে দেয়। বয়স্ক জারোয়া পুরুষ মৃত শিশুকে নিয়ে সৎকারের জন্য গভীর অরণ্যে নিয়ে চলে যায়। গভীর অরণ্যে নিয়ে গিয়ে শিশুটিকে এক কাঁধে রেখে বয়স্ক জারোয়া পায়ের উপর দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে একটু বের করা জিভকে দাঁতে চেপে সে তার দুই কান টেনে ধরে। তারা মনে করে এই সময়ে এক শক্তি তার মধ্যে ভর করে এবং সে মৃত শিশুকে স্বর্গে নিয়ে যায়। জারোয়াদের স্বর্গের নাম হলো 'পাঙনাং চাড্ডা'। চোখ খোলার পরে মৃত শিশুকে সেই বয়স্ক জারোয়া গাছের তলায় কবর দেয়।আবার অবৈধ কোন জারোয়া শিশু সাত থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের হাতে প্রাণ হারায়। জারোয়া সমাজে অবৈধ শিশু অশুভ শক্তির আধার বলে বিবেচিত। বহু শিশুর অকাল মৃত্যু এই কুসংস্কারের ফলে হয়। আবার কোন নবজাতক যদি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে খুবই রুগ্ন বা ওজনে কম থাকে এবং মায়ের বুকের দুধ টানতে পারেনা তখন জারোয়া সমাজের দলপতি কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে নিদান দেয় যে শিশুটি অশুভ শক্তির আধার এবং তাদের সমাজের রীতি-নীতি মেনে তারা সেই শিশুটিকে গভীর জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। গ্রেট আন্দামানিজেরা এবং জারোয়ারা কেহই মৃত ব্যক্তির নামে স্মৃতিস্তম্ভ বা সৌধ বানায় না, শুধু কুটিরস্থানের নাম রাখে মৃত ব্যক্তির নামে। মৃতদেহের সৎকার করার পরে তারা তাড়াতাড়ি শোকগ্রস্ত মনকে স্বাভাবিক করে জীবন যাপন করে। জারোয়াদের সমাজে কিছু কিছু কুসংস্কারের উল্লেখ করছি।

          অবৈধ সন্তানকে জারোয়া সমাজের গোষ্ঠীপতিরা কিছুতেই বেঁচে থাকতে দেয় না। পূজা অর্চনা বা দেবদেবীতে বিশ্বাস জারোয়াদের মধ্যে নেই, তবে তারা অশুভ শক্তিকে বিশ্বাস করে। কোন শিশু বা জারোয়া পুরুষ ও নারী বেশিদিন অসুস্থ অবস্থায় থাকলে তারা বিশ্বাস করে সেই অসুস্থ ব্যক্তির উপরে অশুভ শক্তি ভর করেছে। জারোয়াদের বিশ্বাস মৃত্যুর পর আত্মা স্বর্গে চলে যায়। অসুস্থ অবস্থায় তারা বিশেষ প্রক্রিয়াযোগে শক্তি সঞ্চয় করে স্বর্গে যেয়ে পূর্ব পুরুষদের কাছে চিকিৎসা লাভ করে সুস্থ হয়। তাদের অভিজ্ঞতায় স্বর্গ বা 'পাঙনাং চাড্ডা' খুব ঠাণ্ডা জায়গা। তাদের বিশ্বাস তাদের শিকার করা পশু, কুসংস্কারের বলি নিষ্পাপ শিশুরা, তাদের অতীত পূর্বপুরুষেরা এবং সভ্য জগতের যেসব মানুষকে তারা অতীতে হত্যা করেছে সবাই সেই স্বর্গে নাকি মহা আনন্দে আছে। জারোয়া সমাজের বিভিন্ন সংস্কারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তাদের দলপতি। জারোয়া সমাজে শ্বশুর বা শাশুড়ি জামাইয়ের নাম উচ্চারণ করে না এবং জামাইও শ্বশুর শাশুড়ির নাম কখনো উচ্চারণ করে না। ভূমিকম্পের সময় তাদের ধারণা একটা বড় ভূত শক্ত দড়ি দিয়ে পৃথিবীকে টান দিয়ে দোলায়। তাদের আরো কুসংস্কার জঙ্গলের গোলফল গাছের পাতায় নির্মিত মাথার ব্যান্ড বা রিং পরে শিকারে গেলে শুকর শিকারে সাফল্য আসে। শিকার করা শুকরের মাথা কুটিরে টাঙ্গিয়ে রাখলে তাদের গা হাতের ব্যথা কমে যায়। কুটিরে যত বেশি শুকরের মাথা থাকে ততই তাদের শিকারের দক্ষতা ও সম্প্রদায়ের কাছে সম্মান বাড়ে।

          ডাক্তার করের সঙ্গে আমার দুই ঘণ্টার মত আলাপ-আলোচনা উপরের সমস্ত তথ্য পেয়ে তাকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে আসার পূর্বে তার কাছে জারোয়াদের সামগ্রিক উন্নয়নের ব্যাপারে তার অভিমত জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন বর্তমানে জারোয়াদের সমস্যা ও কল্যাণের জন্য আন্দামান আদিম জনজাতি বিকাশ সমিতি ও ভারত সরকারের জারোয়া কল্যাণ দপ্তর সচেষ্ট। এছাড়াও সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে চিকিৎসার ব্যাপারে তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করা হয়। আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড অরণ্যবাসী জারোয়া ও সভ্য জগতের মানুষের মাঝে ব্যবধান ভেঙে দিয়েছে। প্রস্তরযুগীয় আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া এসেছে তবে সভ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে কিছু অবাঞ্ছিত জিনিস তাদের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। যেমন আন্দামান ট্রাংক রোডে গাড়িগুলির পিছনে ধাওয়া করে খাবার বা জামাকাপড় চেয়ে নেওয়া। পরিশেষে তিনি বললেন মধ্য আন্দামানের কদমতলা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র জারোয়াদের চিকিৎসার ব্যাপারে খুবই সজাগ ও সতর্ক। জারোয়াদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা প্রায় বন্ধ করতে পেরেছে। তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে খুঁটি ও লতাপাতা দিয়ে 'জারোয়া ওয়ার্ড' যেখানে আধুনিক চিকিৎসার সমস্ত সুযোগ সুবিধা রয়েছে। ফলস্বরুপ জারোয়াদের জনসংখ্যা তিরিশ বছরের ব্যবধানে প্রায় আশি শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে অন্যান্য প্রস্তর যুগের মানুষেরা পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে আসার মুখে।

          পরের দিন আমাদের ফেরার পালা। চোদ্দ দিন আন্দামানে কাটিয়ে এখানকার সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরে চললাম। দুপুর সাড়ে বারোটায় আমাদের ফ্লাইট। বীর সাভারকার বিমানবন্দর থেকে আমাদের বিমান ছেড়ে ওপরে ওঠার পরে বিমানের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নীল সমুদ্রের বুকের উপরে সবুজ বনানীর আবছা ছবি। বিদায় আন্দামান। দেড় ঘন্টা পরে বিমান কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করল। এখান থেকে আমাদের গন্তব্য স্থল শহীদ মিনারের পাদদেশে বাস ডিপো। সেখান থেকে মেদিনীপুরের বাস ধরে সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার পীঠস্থান আমাদের বাড়ীতে। 


তথ্যসূত্র:

1. Cellular Jail- The Indian Bastille by S. P. P. K. Naidu.

2. The Cellular Jail - The National Memorial by G. S. Pandey.

3. Cellular Jail- Cells beyond cells by Priten Roy and Swapnesh Choudhury. 

4. আন্দামানের সেলুলার জেল- শ্রী রতন চন্দ্র কর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !