খেয়া


লেখক: কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)


             আজ থেকে বছর দশেক আগে, ঠিক এইখানেই, আবৃত্তি, হাসনুহানার গাছটা পুঁতেছিল। তখন আবৃত্তি ষোড়শী, এখন...! থাক সে কথা।

            খুব ছোটবেলা থেকেই সুন্দর আবৃত্তি ক'রতো ব'লে, স্কুলে গ্রামে ওই নামেই পরিচিতা ছিল। শুভঙ্কর তখন খেয়ার মাঝি। স্কুলে পড়াশোনা না করলেও কথায় কথায় কেমন মনহারানো গান বাঁধত', ভাটিয়ালী...। আবৃত্তি তখন চতুর্দশীর ভরা নদী। শুভঙ্করের ঘাটেই থিতু হ'তে চেয়েছিল!

কিন্ত কীভাবে যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল! আজ আবৃত্তি বড় একা। স্মৃতির টানেই ফিরে এসেছে দেখার আশায়...।

         "আরে! হাসনুহানার নিচে কুঁড়েঘরটা তো ওখানে ছিল না বা থাকার কথা নয়!" নিজের মনেই কথাগুলো বলে উঠল।

             কুঁড়েঘরটা ওখানে দেখে আবৃত্তি একটু অবাকই হল। একপা দুপা করে গাছটার কাছে এসে কুঁড়েঘরটা ভাল করে দেখল। পরম মমতায় আদরের হাসনুহানা গাছটা যেন ওকে কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরে কিছু বলছে। আর কথাগুলো যেন কুঁড়েঘরের দরজা, দেওয়াল ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে।

            আবৃত্তির চোখের কোণ বেয়ে নামছে ভরা কোটাল। কোটালের তীব্র স্রোত ওকে নিয়ে চলেছে দূর অতীতে।

            

***


         "তুমি এত সুন্দর গান বাঁধতে পার, শুনলে মন পাগল হয়ে যায়।"

       "তুমিও তো ভাল আবৃত্তি কর। কি অপূর্ব গলা তোমার! সত্যিই হিংসে করার মতন।"

     "অ্যাই শোনো, মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ কোরোনা। গতকাল একটা গান গাইছিলে, গানের শব্দগুলো বেশ চেনা চেনা...।"

"ঠিক ধরেছ, তোমার কবিতার কিছু শব্দ, লাইন যোগ করে গান বেঁধেছি।"

"বাহ! শুনে মনে ভরে গেল। এবার আমাকে তোমার নৌকায় চড়িয়ে ঘোরাও..."

          সেই শেষ নৌকায় চড়া। তারপর আর শুভঙ্করের দেখা পায়নি। ও যে কোথায় হারিয়ে গেল কেউ বলতে পারেনা। আইলার সেই অভিশপ্ত দিনটা এখনও আবৃত্তি ভুলতে পারেনা। 

... ... ...

         ভাবতে ভাবতে কোথায় তলিয়ে গিয়েছিল। এক পথ চলতি মানুষের ডাকেই সম্বিৎ ফিরল উনিই সব ব্যাখ্যা করলেন। 

          এই কুঁড়েঘরটা শুভঙ্করেরই বানানো। একজনকে ভালবেসে স্বপ্ন দেখেছিল দুজনে একসাথে ঘর বাঁধবে। তারপর তার হঠাৎ বিয়ে হওয়াতে সব ছেদ পড়ল।

         আইলার ঝড়ে নৌকা উল্টে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। বহু বছর পরে এক মাঝি ওকে দেখে চিনতে পারে। 

... ... ...

           শুভঙ্করের স্মৃতি গেছে। নৌকা আর চালায় না। তবে গানটা ভালই গায় আগের মতন। এখন বিভিন্ন মেলাতে পুজো পার্বণে গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। যে যা দেয় তাতেই কোন রকমে একটা পেট চলে যায়। সবাই ভাবে ও একটা বদ্ধ পাগল।

       শুনে আবৃত্তির শুভঙ্করের একটা গান মনে পড়ছে,

       "এই খেয়া বইবি,

       ...কত আর..."

           আবৃত্তির চোখের নোনা জোয়ারে যেন ঐ "খেয়া" ভাসতে ভাসতে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !