প্রতীকিবাদী কবি স্তেফান মালার্মে (অন্তিম পর্ব)


প্রাবন্ধিক: শংকর ব্রহ্ম

অন্তিম পর্ব


তাঁর কয়কটি কবিতা

-------------------


[অনুবাদ: ইমন জুবায়ের]


সমুদ্র-বাতাস

------------


সে মাংস বিষন্ন, হায়!আর সব ছোট নদীগুলি লাল।

সংগ্রাম, কেবলি সংগ্রাম! মনে হয় পাখিরাও হয়ে উঠছে বন্য

অচেনা ফেনার শরীর, আকাশের দিকে ঝুঁকে-থাকা!

না, চোখে তো ভেসে উঠছে না প্রাচীন উদ্যান

যে স্নান করেছে আনন্দে- তার আত্মা স্থির থাক

হে, রাত্রি! আমার নির্ঘুম প্রদীপ-যার নিঃসঙ্গ আলো

খালি পৃষ্ঠার ছায়া, সাক্ষীর অশেষ ফল লাভ,

এমন কী বুকের ওপর শিশু দোলানো অল্প বয়েসী স্ত্রীটিও নয়

আমি বিদায় নেবো! হে স্টিমার, দোলানো রশির খুঁটি

দূরবর্তী আশ্চর্য দেশের অভিমূখে তোল নোঙর!

একটু অস্বস্তি, নিষ্ঠুর আশায় দিশেহারা, এখনও ধরে আছে

শেষ বিদায়ের শেষ রুমাল!

এবং এসব নয়, ঝড়কে ডাকছে মাস্তুল, এসবও নয়

এক সচেতন ঝড় বেঁকে যাচ্ছে বিধস্ত সমুদ্রে,

লুপ্ত, পাল নয়, একটি পাল, একটি পুষ্পিত দ্বীপ, অনেক আগের?

কিন্তু, হে আমার হৃদয়, তুমি শোন, তুমি নাবিকের গান শোন!


নবীকরণ

---------


এখন নিয়েছে বিদায় রুগ্ন বসন্ত

শীত, বিশুদ্ধ শিল্পের ঋতু, নির্মল শীত

আমার সত্তায় ঐ বিষন্ন রক্তের দাহ

দিনভর হাই তুলে জরুরি বিস্তার

কুয়াশার সাদা ভোর আমার করোটিতে কবোষ্ণ বাড়ে

সমাধির মতন লোহার আঙটিতে বন্দি

বিষন্ন আমি খুঁজি চমৎকার আবছা স্বপ্ন

মাঠে-যেখানে কুঁড়িরা শস্যের সবকিছু

তারপর গাছেদের ঘ্রানে সন্তষ্ট আমি

মুখ দিয়ে খুঁড়ি আমার কল্পনার কবর

যেখানে লাইলাকেরা বাড়ছে সেই উষ্ণ মৃত্তিকায় দিই কামড়

নিজেকে র্ভৎসনা করে অপেক্ষা করি বিষাদ অবসানের

এরই মধ্যে চকিত নীলের হাসি ঝোপের ওপর

পাখিদের কলকাকলী আর সূর্যের বাৎসরিক শপথ


সনেট

-------


বিস্মৃত অরণ্যে যখন বিষাদিত শীতেরা নেয় বিদায়

তোমার অভিযোগ নিঃসঙ্গ চৌকাঠে বন্দি

আমাদের অহংকারের এই নিবিড় সমাধিতে

নেই কবিতা ও ফুলের তোড়া

মধ্যরাত্রির অর্থহীন গননা শোনা ব্যাতিরেকেই

রাতের প্রহরী তোমাকে জাগিয়ে রাখবে

তারপর পুরনো আর্মচেয়ারের হাতলে

সর্বশেষ অগ্নিজ্যোতি আমার ছায়াকে দীপ্যমান করে

যার কাছে প্রায়শই অতিথিরা আসে তারা যেন

বহুবিধ ফুল নিয়ে সমাধিতে না আসে

আমার আঙুল নিঃশূন্য বিষন্নতাকে করে নির্দেশ

সার সার সমাধি দেখে কাঁপে আত্মা

এর প্রত্যয়ে বাঁচার জন্য আমি তোমার ঠোঁট থেকে নেব ঋন

দীর্ঘক্ষণ আমার নামের নিঃশ্বাস মর্মর করবে সন্ধ্যায়


স্বাগত-সম্ভাষণ

---------------


কিছুই না- এই ফেনিল কুমারী কাব্য

পেয়ালাই সর্বাধিক গুরুত্ব পাবার যোগ্য

এভাবে, দুরে সৈন্যদলের পদধ্বনি

এলোমেলো শিঙার ধ্বনি

আমরা জলপথে চলেছি হে আমার বিচিত্র

বন্ধুরা! আমি এরই মধ্যে মাস্তুলে

তুমি শীত ও বিদ্যুত কেটে কেটে

অগ্রসর হওয়া মহার্ঘ গলুয়ে

এক চমৎকার নদী আমাকে ডাকছে

তার ঢেউয়ে ভীত না হয়ে

এই দৃঢ় স্বাস্থপানের জন্য

নিঃসঙ্গতা খাড়ি নক্ষত্র

যাই হোক না কেন

আমাদের পালের শ্বেত উদ্বেগ


একটি কবিতার উপহার

---------------------


প্রাচীন রাত্রির শিশুটিকে আমি তোমার কাছে আনি

কালো, ডানায় রক্ত, ফ্যকাশে পালকহীন

কাচ এর ভিতরে পুড়ছিল স্বর্ণ ও আগর

জানালার কাচের ওপাশে জমাট তখনও বিষন্ন -হায়

দেবদূত প্রদীপে বিস্ফারিত হয় ভোর

করতল! এবং যখন এটি দেখায় ভগ্নাবশেষ

আবারও শক্রর হাসির জন্য চেষ্টা করছে

নীল অনুর্বর নিঃসঙ্গতার শিহরণ

ও ধাত্রি, তোমার নিষ্পাপ শিশু

তোমার শীতল পা, এই জন্মকে গ্রহন করে

তোমার স্বরে মনে পড়ে ক্লাভেচিনের বেহালা

তোমার ভাঁজ করা আঙুলে তুমি কি চাপ দেবে স্তনে

যখন শ্বেত পুরোহিত নারীরা হয় প্রবাহিত

নীল কুমারী বাতাসে ঠোঁটেরা হয়ে ওঠে ক্ষুধার্ত



(উৎসর্গ: নাজিম উদদীন। যাঁর ফরাসি ভাষাজ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করেছে। - ইমন জুবায়ের।)


[অনুবাদ: আজফার হোসেন]


প্রতিষঙ্গের প্রেতাত্মা

------------------


তোমার ঠোঁটে গেয়েছিল গান নাম-না-জানা শব্দরা? এক অসম্ভব বাকধারার অভিশপ্ত টুকরো?


ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে আসি, কোন এক বাদ্যযন্ত্রের তারের ওপর পিছলে-পড়া পালকের মতো অনুভব সঙ্গে নিয়ে, বিনম্র ও বহতা, যার স্থান করে নেয় একটি কণ্ঠস্বর, ধীরে ধীরে নেমে-যাওয়া ধ্বনিতরঙ্গায়িত শব্দের উচ্চারণে: “লা পেনালতিয়েম এ মখত্” এবং শব্দগুলো উচ্চারিত হয় এমনভাবে যেন পঙ্ক্তির অন্তে ঝুলে আছে ‘লা পেনালতিয়েম’, আর ‘এ মখত্’ সেই অদৃষ্টময় বর্ণমালা, অর্থের নাক্ষত্রিক নৈঃশব্দ্যে। পরে কয়েক পা ফেলতেই ‘নাল’ ধ্বনিতে অনুভব করি বাদ্যযন্ত্রের একটি টানটান তীর। সে ছিল বিস্মরণে– মহীয়ান স্মৃতি নিশ্চিত তাকে ছুঁয়ে গেছে পালক কিংবা পত্র কিংবা তালু দিয়ে। রহস্যের নকসার ওপর আঙুল আমার, মৃদু হেসে আমি প্রার্থনা করলাম এক ভিন্ন অনুধ্যানের বিষয়ের জন্য, বুদ্ধিবৃত্তিক আকাঙ্খায়। ছিঁড়ে-যাওয়া পালক কিংবা পাতার প্রাক্তন পতন থেকে তখন ফিরে এলো বাকধারা, নিশ্চিত, আগের মতোই। এখন থেকে তাকে শোনা যাবে কণ্ঠস্বরের উচ্চারণে ততোক্ষণ ধরে যতোক্ষণ না সে অবশেষে নিজের উচ্চারণে জানান-দেয়া উপস্থিতিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র একটি বোধে আর তৃপ্ত না থেকে আমি তাকে মনে মনে মিত্রাক্ষরের মতো পাঠ করতে থাকি। আর একবার পরখহেতু আমার বয়ানের সঙ্গে মিলিয়ে উচ্চারণ করি উঁচু গলায়। শীঘ্রি তাকে এমনভাবে উচ্চারণ করতে থাকি যে, ‘পেনালতিয়েম’-এর পর একটি যতির নৈঃশব্দ্য থেকে যায় : কী বিষণ্ন আনন্দ! ‘পেনালতিয়েম’ : বাদ্যযন্ত্রের তার, নাল ধ্বনির বিস্মরণে প্রসারিত ও তীব্র, ভেঙে পড়ল নিশ্চিত, আর আমি এক ধরনের প্রার্থনা জুড়ে দিলাম : ‘এ মখত’। আমার প্রিয় সব ভাবনায় ফিরে আসার চেষ্টা না থামিয়েই দাবি জানাই নিজেকে শান্ত করার, এই ভেবে যে, পেনালতিয়েম নিশ্চিতভাবে একটি আভিধানিক শব্দ যার অর্থ: একটি শব্দের অন্তিম অক্ষরের প্রাগাক্ষর। সেই আমার ভাষার কাজ শেষে খুব সাধারণভাবেই শব্দটি দিনের পর দিন আমার মহীয়ান কাব্যগুণের ওপর আছড়ে পড়ে, বাধা পেয়ে সে ফুঁপিয়ে কাঁদে প্রতিদিন। এমনকি থামতে-না-জানা হাঁ-জানান-দেওয়া ভঙ্গির ক্ষিপ্রতায় রূপ-নেয়া ধ্বনির জমাট ভার আর মিথ্যার প্রতিভাস হয়ে উঠেছিল যন্ত্রণার কারণ। দুশ্চিন্তায় আমি বাক্যাংশের ভেতর থেকে বিষণ্ন ধরনের শব্দগুলোকে আমার ঠোঁটের চারদিকে হেঁটে চলার সুযোগ দিলাম। আর আমি হাঁটতে লাগলাম। কণ্ঠে আমার সমবেদনা-জাগানিয়া গুঞ্জন: “উপাধাটি মৃত, সম্পূর্ণ মৃত, রে দুর্ভাগা উপাধা”। আর ভাবতে থাকলাম, আমার অস্তিত্বকে এভাবে আমি সান্ত¡না দিতে পারি, লুকিয়ে-থাকা প্রত্যাশাও ছিল তাকে দাফন করার। সাঙ্গীতিক বিস্তারে যখন কী এক আতঙ্কে, কী এক সহজিয়া কিন্তু অস্বস্তিকর সম্মোহনে অনুভব করলাম যে, দোকানের জানালায় ছায়া-ফেলা আমার হাতখানা কাউকে জড়িয়ে ধরবে বলে নিচে নেমে যাচ্ছে, তখনই অধিকারে এলো সেই কণ্ঠস্বর [যা শুনেছিলাম গোড়াতেই, নিশ্চিতভাবে যা ছিল এক ও একমাত্র।]। কিন্তু যে-মুহূর্তে পরাপ্রাকৃতের প্রতিকারহীন প্রবেশের ভেতর-পথ স্পষ্ট হল এবং যন্ত্রণার কুচকাওয়াজ শুরু হল, যার নিচে কষ্টে মোচড় খেতো আমার এক সময়ের রাজকীয় সংবেদন, সেই সময় চোখ তুলে দেখলাম আমি হাঁটছিলাম প্রাচীন দ্রব্য-ব্যবসায়ীদের রাস্তা ধরে; দাঁড়িয়েছিলাম এক বেহালানির্মাতার দোকানের সামনে। বিক্রির জন্য সেখানে ছিল দেয়ালে ঝুলে-থাকা পুরনো বাদ্যযন্ত্র এবং মেঝেতে পড়ে-থাকা কিছু হলুদ তালপত্র এবং ছায়ার ভেতরে লুকিয়ে-থাকা প্রাচিন পাখিদের পালক। অপ্রকৃতিস্থের মতো আমি পালিয়ে গেলাম। সম্ভবত দুর্জ্ঞেয় ‘পেনালতিয়েম’-এর জন্য আমার এই অদৃষ্টময় বিলাপ।


[“লা পেনালতিয়েম এ মখত্” একটি ফরাসি বাক্য, বাংলায় যার ভাষান্তরিত রূপ হতে পারে এমন: উপধাটি মৃত।]


 ভবিষ্যের দিকে

---------------


বুড়িয়ে যাওয়ায় মরে-যাচ্ছে-যাচ্ছে এমন এক পৃথিবীর ঊর্ধ্বে মেঘেদের সাথে হয়তো বিদায় নেবে ফ্যাকাশে আকাশ এক। সূর্যের কিরণ আর জল দিয়ে ঢেকে-রাখা দিগন্তের ওপর ঘুমিয়ে-পড়া নদীর ভেতর সূর্যাস্তগুলোর ছেঁড়া-ছেঁড়া গোলাপী ক্ষয়ের চিহ্ন সব মিলিয়ে যায়। একঘেঁয়ে সময়ের ভারে গাছগাছালি সব অবসন্ন। আর তাদের শাদা-হয়ে-যাওয়া পাতাগুলোর নিচে পথের নয় বরঞ্চ সময়ের ধুলোবালিতে ক্যাম্বিস তাঁবু নিয়ে জেগে ওঠে অতীত সব চিহ্নের সঙঃ গোধূলির অপেক্ষায় থাকে অনেক গ্যাসবাতি। তারা আবারও জাগিয়ে তোলে অসুখী ভিড়ের সেই সব মুখ। আর অবিনাশী রুগ্নতা এবং বহু শতকের জমা পাপ তাদের জয় করে নেয়। তাদের কিনারে থাকে ভয়াবহ দুঃসঙ্গী সব, এক অমাঙ্গলিক ফলের ভারে ভারাক্রান্ত। পৃথিবী বিলীন হবে এই ফলের সঙ্গে। সমস্ত চোখের পীড়িত নৈঃশব্দে ডুবে থাকে স্থান, যে নৈঃশব্দ্য সূর্যের কাছে মিনতি জানায়, যে সূর্য একটি ধ্বনির হতাশায় ডুব দেয় জলে। সঙ কথা কয় নিচু স্বরে: ‘ভেতরে প্রদর্শনী দেখাবে বলে তোমাকে আমোদিত করার এমন কোনো চিহ্ন নেই। কারণ এখন এমন কোনো চিত্রকর নেই যে আঁকতে পারে তার ক্ষীণতম প্রতিচ্ছায়া। আমি তোমাদের কাছে নিয়ে আসি সেই কবেকার জীবন্ত এক নারীকে। (যাকে সার্বভৌম বিজ্ঞান বছরগুলোতে সংরক্ষণ করে রেখেছে।)’ কিছু পাগলামি, মৌলিক ও সরল, একটি সোনালি উল্লাস ও উন্মাদনা, আমি জানিনা কী তা! যাকে সে তার চুল বলে, বুননের বৈভবে যেন সে ছড়িয়ে থাকে তার ঠোঁটের রক্ত-লাল নগ্নতায় জ্বলে-ওঠা মুখের চারিদিক। শূন্যতার পোষাক খসে পড়ে। থাকে তার দেহ। অমূল্য হিরন্ময় পাথরের মতো তার চোখ সেই দৃষ্টির সমান নয়, যে দৃষ্টি উঠে আসে তার সুখময় মাংশের স্বরঃচ্ছন্দ থেকে: সেই 

দৃষ্টি জেগে ওঠে তার স্তনযুগল থেকে যেন তারা অনন্ত দুধের ভরাট ভাণ্ড। তাদের চূড়া নিশানার মতো জেগে থাকে আকাশের দিকে, বিস্মরণময় পা দিয়ে এঁকে-যাওয়া দাগের দিকে, যার দেহে থেকে যায় আদিম সমুদ্রের নুন। তাদের অসহায়, ক্লান্তিকর, রুগ্ন ও আতঙ্কিত স্ত্রীদের কথা স্মরণ করে স্বামীরা একসাথে ভিড় জমায়। তাদের বিষণ্ন স্ত্রীরা দেখে নিতে চায় কৌতূহলে।

                    কোনো এক পূর্ব-অভিশপ্ত যুগ থেকে ছাড়া-পাওয়া সেই মহীয়ান প্রাণীটির দিকে যখন সকলেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে, তারা আবার একে অন্যের দিকেও তাকাবে, কেউ কেউ নিরঞ্জন ঔদাসীন্যে, কেননা কি হচ্ছে তা বোঝার ক্ষমতা নেই তাদের। কিন্তু অন্যরা তাকাবে বিষণ্নভাবে যখন তাদের চোখের পাতা ভিজে থাকবে সমর্পিত জলে; যখন এই সময়ের কবিদের ঘোলা চোখ উঠবে জ্বলে। তারা এগিয়ে যাবে তাদের বাতিগুলোর দিকে। মুহূর্তের জন্য হলেও একটি বিভ্রান্ত মহিমায় তাদের মস্তিষ্ক উত্তেজিত হবে উন্মাদনায়। তারা আক্রান্ত ও আলোকিত হবে ছন্দঃব্রহ্মে। আর তারা ভুলে যাবে যে, তাদের অস্তিত্ব এমন এক যুগে, যে-যুগ সৌন্দর্যের চেয়েও ঢের বয়সী।


[অনুবাদ: অদিতী ফাল্গুনী]


এক ছাগ দেবতার অপরাহ্ন (ÔL’après-midi d’un faune)

--------------------------------------------------


 রোমক পুরাণে বর্ণিত এক ছাগ দেবতা :

সেই পরীদের চির অমর দেখতে চাই আমি,

যারা এত স্বচ্ছ

যেনবা অতীব লঘু দেহ তাদের বাতাসে ভাসে,

বাতাসে চপল দেহবিভঙ্গ ওদের

নিয়ে আসে গাঢ়, পত্রপল্লবিত নিদ্রার ঘোর।

আমি কি ভালবেসেছিলাম এক স্বপ্ন?

আমার সন্দেহ, যেন প্রাচীন রাত্রির স্তপ, গোলকধাঁধাঁর মত

শাখা-প্রশাখায় খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই পরীদের।

হাতড়ে খুঁজে ফেরা সেই একই প্রকৃত অরণ্য

যা প্রকাশ করে

গোলাপের আদর্শ ভুল হিসেবে আমার বিজয়।

একবার বিবেচনা করো…

তোমার ভাবনায় সদা উদ্ভাসিত নারীরা

আসলে তোমারই কল্প-বাসনার প্রতিমা!

হে ছাগ দেবতা, পবিত্রতর পরীর তুষার শীতল নীল চোখ

থেকে তবু বিভ্রম ছড়ায় যেনবা ক্রন্দনশীল ঝর্ণা।

আর অন্য যা কিছু দীর্ঘশ্বাসে প্রোথিত,

তুমি বলতে চাও সেসবই

ভেড়ার পশমের মত তপ্ত দুপুরের হাওয়ার সাথে তূল্য?

না! তীব্র গরমের এই শ্বাসরোধী সকালের গতিহীণ,

ক্লান্ত মূর্ছার ভেতর দিয়ে,

আমার বাঁশী ব্যতীত উপবনের ভেতর দিয়ে

কলকল শব্দে প্রবাহিত নয় কোন জলধারা।

দিগন্তের একমাত্র বায়ুতে কোন লহরী নেই,

আমার যমজ পাইপ থেকে নি:সৃত এবং সহজে নিষ্কাশনক্ষম

সুরধারা বৃষ্টির শুষ্ক প্রবাহে যেন

সেই দৃশ্য, শান্ত ও অলীক প্রেরণাদায়ী বায়ু

যা জেগে উঠছে প্রার্থনার মত।


চেহারা (Poème Apparition)

--------------------------


দু:খী হয়ে পড়ছিল চাঁদ। ক্রন্দনশীল দেবশিশুরা স্বপ্ন দেখছিল।

শান্ত ও বাষ্পীয় পুষ্পস্তবকে তাদের তীরবাহী আঙুল

যেন বা তাদের মরণাপন্ন বেহালার তার বাদিত হচ্ছিল

আর আকাশ-নীল ফুলের পাঁপড়িতে গড়িয়ে পড়ছিল শ্বেত অশ্রু।

সে ছিল তোমার প্রথম চুম্বনের আশীর্ব্বাদধন্য দিন,

এবং আমি শহীদ হলাম আমার স্বপ্নের কাছে,

বেঁচেছিল যা বিষাদের সুগন্ধীর উপর ভর করে,

যা এমনকি কোন পরিতাপ বা দূর্ঘটনা ব্যতীতই

একটি স্বপ্নকে সেই হৃদয়ের কাছে রেখে যায়

যে প্রথম স্বপ্নটি তুলেছিল।

এখানে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, পুরণো পাথর বাঁধাই সড়কে

আমার চোখ নাচছিল।

যখন তোমার চুলে সূর্যের উচ্ছাস নিয়ে, রাস্তায় এবং রাত্রিতে,

তুমি সহাস্যে আমার কাছে এসেছো,

এবং আমি ভাবলাম আমি দেখছি আলোর টুপি পরা এক পরীকে,

যে আমার শৈশব নিদ্রার স্বপ্নে দেখা দিত,

এবং যার অর্দ্ধমুষ্টি হাত থেকে

সুগন্ধী নক্ষত্ররাজিতে ঝরে পড়ছে পুঞ্জ পুঞ্জ তুষার।

বৃক্ষের সূক্ষ যত শাখায়।


জানালা (Les fenêtres)

----------------------


দু:খী হাসপাতালের পূতি গন্ধে ক্লান্ত

যে গন্ধ বেয়ে উঠছে আর বসে যাচ্ছে পর্দার

বস্তাপচা সাদায়,

শুণ্য দেয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর বিপুল অবসাদ,

অসুখী ওয়ার্ডে মৃতপ্রায় সেই বৃদ্ধ বসে আছেন প্রায়ান্ধকার ঘরে।


বৃদ্ধ শিরদাঁড়ায় কখনো কখনো ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন,

জানালার সামনের পাথররাজি দেখার ইচ্ছে তত নেই-

যারা যতটা না রোদে পোড়া ততটা নয় তপ্ত

আর ক্ষয় হতে পারে যখন তখন,

জানালার শার্সিতে তবু তাঁর সাদাটে চোয়াল

আর চোয়ালের হাড় আঠার মত সেঁটে থাকে-

যে শার্সি আহা মিষ্টি রোদ্দুরে বাদামী।


জ্বরগ্রস্থ মুখখানা তার নীলের জন্য বড্ড লোভী

যেমনটা বহু বহু আগে, এক কুমারী ত্বকে, নোনা চুমু দেবার আশায়,

তৃষার্ত হয়ে উঠতেন তিনি, আর দীর্ঘ আলিঙ্গন,

সোনালী, কবোষ্ণ বর্গক্ষেত্রে দীর্ঘ কর্ষণ।


আসবমত্ত তিনি বেঁচে থাকেন, পরিশোধিত যত ঔষধি ভুলে,

কফ, ঘড়ি, পবিত্র যত তেল, যে বিছানায় তাঁর মৃত্যু হয়;

আর সন্ধ্যা যখন রক্তক্ষরণ করছে তাঁর যাবতীয় প্রতিবন্ধকতার উপরে,

তাঁর চোখজোড়া, দিগন্তের আলোয় সেঁটে আছে।


বেগুণীবর্ণ ঢেউয়ের উপরে তিনি দেখতে পান স্পেনীয় অর্ণবপোত,

সুরভিত, যেন বা সমাধিগ্রস্থ রাজহংসের ঝাঁক সাঁতার কাটছে,

ঐশ্বর্যময় আলোর রেখার চমকে সাজাচ্ছে তারা সারিবদ্ধ রেখা

স্মরণে প্লাবিত এক পরম আলস্যে।


সুতরাং কঠোর হৃদয় পুরুষদের প্রতি বিরূপ হয়ে,

যাদের স্বাদের শেকড় শুধুই সুখের গোবরগাদায়,

জলাভূমিতে দৃঢ়, সেই নারীকেই তারা কিছু কিছু দান করে

যে স্তন্য পান করায় তার শিশুদের।


আমি উড়ে যাই, এবং প্রতিটি জানালার সাথে সেঁটে থেকে,

কাব্য করি, জীবনের দিকে ফিরে আমার কাঁধ পরিতাপ করে,

চিরায়ত শিশিরে ধোয়া গ্লাসে তাদের

অসীমের পবিত্র সকালের অপরাধবোধ।

দেবদূতের মত প্রতিসরিত আমি! এবং আমি মরছি,

আর প্রেম, শিল্পের জানালায় রহস্যের বিষন্ন হয়ে থাকা,

পুনরায় জন্ম নেয়া, স্বপ্ন-মুকুট পরা, আরো আগের আকাশে,

যেখানে রূপ প্রথম তার কুঁড়ি থেকে ফেটে প্রস্ফুটিত হয়েছিল।


কিন্ত নিচে এখানে ঈশ্বর আছেন এবং তিনি পরম দয়ালু, আহা!

ধিক্কার আমাকে এমনকি যখন আমি আমার গোলাপও শুঁকি,

মানুষের নিতম্বের নোংরা বমন

আকাশের সামনে আমাকে বাধ্য করে

চেপে ধরতে নাসারন্ধ্র আমার!


এমন কি উপায় নেই কোন যে তিক্ত যত প্রতিবন্ধকতা নিয়েই,

রূঢ়ভাবে কলুষিত

এই জানালার কাঁচ ভেঙে

উড়ে যেতে পারি নিঃসীম নীলে উন্মুক্ত দুই পক্ষ বিস্তার করে?

— অনন্তের ভেতর পতিত হবার সম্ভাবনা নিয়েই?  


------------------------

[(সংগৃহীত ও সম্পাদিত)

ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার-

১) তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল।

২) ইমন জুবায়ের।

৩) রুখসানা হক।

৪) আজফার হোসেন।

৫) অদিতী ফাল্গুনী।]

সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !