কবি: শুভ দাশগুপ্ত
আজও দেরি হয়ে গেল অর্ধেন্দু বাবুর।
ইদানিং রোজই এরকম দেরি হয়ে যাচ্ছে, ঘুম ভাঙতে চায় না।
সকালে উঠে হাঁটুতে আর গোড়ালির নিচে অনেকক্ষণ একটা আড়ষ্ট ব্যাথা খুব দুর্ভোগে ফেলে।
তারপর, বারোঘর, একখানা কলের বারোয়ারি সংসার, বস্তির টালির ঘরে একাজ-ওকাজ সেরে অর্ধেন্দু বাবুর বড়ো দেরি হয়ে যায়!
আজও দেরি হয়ে গেল অনেকটা।
ছাত্রের বাড়ি অনেকটা পথ, হেঁটেই যেতে হয়।
রিকশায় গেলে নগদ দুটো টাকা, তার চেয়ে হাঁটাই ভালো।
ইদানিং বয়স্ক তো কম হলো না!
হাটার গতিও এসেছে কমে, চোখে যেন শক্তি গেছে অনেকটাই।
ছাত্রের বাড়ি সকালের এই পড়ানোটুকু নানা দিক থেকেই অর্ধেন্দু বাবুর খুব প্রিয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সান্যাল বাবুরা ভদ্রলোক। পড়াতে গিয়ে কিছুক্ষণ পরেই ছাত্রের মা ঘরে এসে নিজের হাতে দিয়ে যান সুন্দর কাপ-প্লেটে চা, সঙ্গে অন্তত দুখানা ভালো বিস্কুট। সারাদিনে আর তো খুব একটা চা খাওয়া হয়না অর্ধেন্দু বাবুর, নিজের একলা সংসারে চা-টায়ের কোন পার্ট রাখেননি।
অর্ধেন্দু বাবুর এই ছাত্রটি নিখিলেশ, এমনিতে খারাপ নয়! তবে উঠতি বয়স, নানা আকর্ষণ-নানা দুষ্টুমি। দিন দিন বড়ো অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। রেজাল্টও ভালো হচ্ছে না। এ নিয়ে নিখিলেশের মা অনেক বার হাসিমুখে অনুযোগ জানিয়েছেন ছেলের বৃদ্ধ টিউটরটির কাছে, "আপনি মাস্টারমশাই একটু ভালো করে দেখুন ওকে, আরেকটু সময় দিন। ও তো পরেই না, আপনি এলে ওই যেটুকু ওর পড়া। তারপর দিন দিন বড্ড অবাধ্য আর জেদি হয়ে উঠছে। আপনি একটু কড়া হন মাস্টারমশাই।"
আজ মিত্তির পাড়ায় ঢুকেই অবনী ডাক্তারের চেম্বারে ঘড়িটা দেখলেন। না, সত্যিই আজ বড্ড দেরি করে ফেলেছেন, নিখিলেশের পরীক্ষা সামনে!
বারান্দায় চটিটা রেখে ঘরে ঢুকে অর্ধেন্দু বাবু বসলেন তার নির্দিষ্ট চেয়ারে। ঘরের টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে নিখিলেশ নেই।
মিনিট কয়েক পরে নিখিলেশের মা ঢুকলেন, হাতে চায়ের কাপ প্লেট।
"চা খেয়ে নিন মাস্টারমশাই!"
গৃহকর্ত্রীর কণ্ঠস্বরে যেন কেমন থমথমে ভাব।
মাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, "নিখিল বাড়ি নেই?"
নিখিলেশের মা এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বললেন, "চাটা খেয়ে নিন, আমি আসছি।"
কেমন অবাক লাগল অর্ধেন্দু বাবুর। এ বাড়িতে তিনি অনেক বাড়িতে অনেক বছর ধরে আছেন। কখনোই মহিলাকে এমন গম্ভীর দেখেননি তিনি।
নিখিলেশের মা আবার ঘরে ঢুকলেন থমথমে মুখ।
অর্ধেন্দু বাবু বললেন, "আজও বড্ড দেরি করে ফেললাম মা। আসলে বয়স হয়ে যাচ্ছে তো! এক সময়ে এইটুকু পথ পাঁচ মিনিটে পেরিয়ে যেতাম হনহন করে। রক্তের জোর গেছে কমে, এটুকু আসতে প্রায় কুড়ি মিনিট লেগে যায়। বাতের ব্যথা, তার ওপর..."
"মাস্টারমশাই এই নিন আপনার এক মাসের টাকা।"
"টাকা, এখন কেন? আজ তো সবে দশ তারিখ। এই তো এক তারিখে মাইনে দিলে মা।"
"উনি বলে গেছেন, নিখিলকে আপনার আর পড়াতে হবে না। আপনি যথাসাধ্য করেছেন এতদিন। ওই নিজের বুদ্ধির দোষে গোল্লায় যাচ্ছে। ওর জন্য ওর বাবা একজন কড়া ধাতের ইয়ং মাস্টার জোগাড় করেছেন। আপনি ভুল বুঝবেন না! আপনি বৃদ্ধ হয়েছেন, শরীরও চলছে না। আপনার এবার বিশ্রাম নেবার সময়। আপনি আসুন... যাই আমি রান্নাঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে। টাকাটা পকেটে নিয়ে নিন মাস্টারমশাই, আসবেন মাঝে মাঝে।"
মফস্বলের মিল ফ্যাক্টরির এই আধা শহরে নটার বাঁশি বাজছে। মিলে ভোরের সিফটের কর্মীদের এখন টিফিন হলো। রাস্তা জুড়ে এখন সাইকেল আর মানুষের ভিড়। কলকাতায় অফিস বাবুরা উল্টোমুখে ছুটছে ট্রেন ধরতে স্টেশনে। কোলাহল-ভিড় মিত্তির পাড়া এখন সরগরম। শুধু একটা খুব চেনা-খুব জানা ঘরের ভেতরে কাঠের চেয়ারে বসে অর্ধেন্দু বাবু সব কোলাহলের বাইরে এক আশ্চর্য স্তব্ধতায় থমকে বসে রইলেন। তারপর আস্তে করে উঠে দাঁড়ালেন। চা-টা পুরো খাওয়া হয়নি। টাকার নোটগুলোর দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন তার এতদিনের বসা সেই চেয়ারখানার দিকে।
দামি শাল কাঠের সৌখিন চেয়ার। এ বাড়ির রুচি আর অর্থের ছাপ লাগা সেই চেনা চেয়ারটার গায়ে হাত রেখে একটু দাঁড়ালেন।
তারপর যেন ছেলেবেলার স্কুলের ফাংশনে আবৃত্তি করছেন এমনভাবে বলতে লাগলেন, "গাছ বুড়ো হয়ে গেলে, কাঠ হয়-কাঠের চেয়ার হয়-কাঠের খাট হয়-টেবিল হয়। কাঠ মানুষের কত কাজে লাগে! মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে.. মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে..."
তিনি না পরের লাইনগুলো ভুলে গেছেন, কিছুতেই মনে আসছে না। বিড়বিড় করতে করতে বারান্দার চটিতে পা গলিয়ে মিত্তির পাড়া ছেড়ে ধীর পায়ে বৃদ্ধ অর্ধেন্দু বাবু ফিরে গেলেন।
পড়ার ঘরের টেবিলে তখন আধ খাওয়া চায়ের কাপে মাছি বসেছে। পেপার ওয়েটে চাপা দেওয়া পাঁচটা দশ টাকার নোট হাওয়ায় কাঁপছে।
Please do not enter any spam link in the comment box.