অবনী স্যার


কবি: শুভ দাশগুপ্ত


ছাত্র পড়ানোয় অবনী স্যারের খ্যাতি ছিল খুব। দূর দূর থেকে ছাত্ররা আসত অবনী স্যারের কাছে অংক ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পড়তে। উজ্জ্বল গৌর বর্ণ, দীর্ঘ নাশা, পৌরাণিক যুগের ব্রাহ্মণের মতো দৈব চেহারা ছিল অবনী স্যারের। পরনে একটা ধুতি, আর খালি গায়ে একটা চাদর কিম্বা একটা যেমন তেমন বিছানার চাদর। গলায় ধবধবে পৈতে, ভারি সুন্দর ছিলেন অবনী স্যার । অবনী স্যারের হাতে পড়ে কত ছাত্র যে জীবনের চলার পথকে সুগম করে তুলতে পেরেছিল, তার ইয়ত্তা নেই। একদিন দাদার হাত ধরে গিয়ে ভর্তি হলাম অবনী স্যারের ভাঙ্গা ঘরে ক্লাসে। আমাকে দেখেই বললেন “বাহ্ ! তুই তো বেশ লম্বা রে! লম্বা লোকেরা বুদ্ধিমান হয়। বেঁটেরাও হয়, তবে বেঁটেদের গাঁটে গাঁটে বদ বুদ্ধি বুঝলি? বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন খালি গায়ে ধূতি পরা অবনী স্যার। বিয়ে থাওয়া করেননি।

নিজে রান্না করে খেতেন। পান্ডিত্যের জন্য তার খ্যাতি ছিল। কিন্তু খ্যাতি অখ্যাতির কোন তোয়াক্কা কোনদিনই করতেন না। বলতেন, "যার যা কাজ সেটা ঠিকমতো করাটাই ধর্ম । গাছের কাজ ছায়া দেওয়া, ফুল ফল দেওয়া, মৌমাছির কাজ মধু জমানো, আমার কাজ ছাত্র গুলোকে মানুষ করে তোলা।" ফিজিক্স আর অঙ্কর ফাঁকে ফোকরে অবনী স্যার কত গল্প করতেন। বলতেন দেশ-বিদেশের বড় বড় মনীষীদের কথা। তাদের জীবনের নানা ওঠাপড়ার গল্প, শোনাতেন উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, কখনও বা মাইকেলের অমিত্রাক্ষরে গাঁথা অপূর্ব কাব্য, কখনো শোনাতেন অতুলপ্রসাদের মরমী গান। লেখা পড়ার হাত ধরে চলতে চলতে আমাদের বোধ আর মননে অবনী স্যার এঁকে দিতেন পৃথিবীর আসল চেহারাটার ছবি। লোভ, পাশবিকতা, শোষণ, দারিদ্র্য সবকিছু নিয়ে এমন অনায়াসে বুঝিয়ে দিতেন কোন ঘটনার কি কারণ, আমরা মনে মনে রোমাঞ্চিত, আলোড়িত হতাম। অবনী স্যার শোনাতেন রাশিয়া বিপ্লবের কথা। ক্ষুদিরাম মাস্টারদার কথা, তিতুমীরের গল্প। শোনাতেন তারাশঙ্করের গণদেবতা, কিংবা শরৎচন্দ্রের “পথের দাবী”র গল্প। কর্মন্যস্ত জীবনের ছোটখাট অবকাশে যখনই ভেবেছি, স্যার আমাদের জন্য কত কী করলেন, আমরা কী করলাম ? তখনই মনটা ভারি হয়ে ওঠে। প্রবাসে থাকি, বাংলার জন্য মন কাঁদে । বন্ধু, আত্মীয় অনেকের কথাই ঘুরেফিরে মনে আসে। অবনী স্যারের কথাও খুব মনে পড়ে। পুজোর ছুটিতে বছর পাঁচেক আগে সেবার দেশে ফেরার আয়োজন করলাম। ফেরার পথে এ সি টু টায়ারে আরামে বসে বসে বারবার মনে পড়ছে স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা। মনশ্চোক্ষে দেখতে পাচ্ছি ভাঙাচোরা সেই অবিন্যস্ত ঘর, যেখানে বসে ক্যালকুলাস আর কেমিস্ট্রির ফাঁকে অবনী স্যার বলে যেতেন জীবনের কথা, ইতিহাসের কথা। বাড়ি ঢুকে এতদিন পরে এলে যা হয়, অনেকটা সময় চলে গেল কথায়, কুশল প্রশ্নে। তারপর পোশাক পাল্টে, পাড়ার মোড়ে গিয়ে হাজির হলাম। ফণিদার চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়াতেই নানা জনের নানা প্রশ্ন। কিরে, সন্তু না? কী খবর? কেমন আছিস? তারপর? কেমন আছিস ওখানে?

এখানে যা অবস্থা? ভালো করেছিস বাংলার বাইরে চলে গেছিস। ওয়েস্টবেঙ্গলের তেরোটা বেজে গেছে বুঝলি? এইসব আপ্পায়ন ইত্যাদির পর পা বাড়ালাম বকুল তলার দিকে, একটা পুরনো বহু পুরনো শিব মন্দিরের ঠিক পেছনে তেঁতুল গাছের পাশে গঙ্গার ধার ঘেঁষে ছিল অবনী স্যার এর ভাঙাচোরা একতলা। হাঁটতে হাঁটতে পুরনো পাড়ার রুপ বদল দেখছিলাম। মোড় ঘুরতেই অবাক! একি! তেঁতুল গাছটা নেই তো! মন্দিরের পেছনে পা চালিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে বুকটা হু হু করে উঠলো। স্যারের বাড়ি টা উধাও, নেই! সেখানে একটা চার তলা ফ্ল্যাট বাড়ি। ব্যালকনিতে চলছে শাড়ি, বেডকাভার, পাশে আর একটা ঐরকমই বাড়ি। নদীর পাড় ঘেঁষে নতুন রাস্তা হয়েছে।স্যারের বাড়িটা মানচিত্র থেকে কেউ যেন ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে। এঁকেছে অন্য রকমের ছবি। মনটা ভীষন ভেঙে গেল। গঙ্গার পাড় ঘেঁষে নতুন রাস্তা, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম একা। মনের ভেতরে নানা প্রশ্নের ঝড়। কোথায় গেলেন অবনী স্যার? কি হলো তার সেই ভাঙাচোরা জীর্ণ বাড়িটার? যা আমাদের কাছে মন্দির মসজিদের চেয়েও বড়। ছেলেবেলার বন্ধু অপূর্বর সঙ্গে দেখা হলো। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। শন্তু না? কিরে? কি খবর? কতদিন পর দেখলাম তোকে। কেমন আছিস? চেহারাটা অনেক বদলে গেছে তোর। এ কথা সে কথার ফাঁকে অপূর্বর কাছে জানতে চাইলাম স্যারের কথা। ও ও পড়তো অবনী স্যার এর কাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের বাজার করা ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে অপূর্ব বলল, "সে অনেক গল্প, লম্বা কাহিনী। সন্তু, তুই প্রায় বছর বিশেক বাইরে চলে গেছিস। এ দেশের হাল হকিকত এই দুই দশকে কত যে বদলে গেছে, হয়তো কিছুই খোঁজ রাখিস না, বাইরের চেহারাই শুধু নয়, মনে মনেও পাল্টে গেছে, এই মফস্বলের ছোট্ট শহর। শুধু এটাই নয়, পাল্টে গেছে, পাল্টে যাচ্ছে গোটা বাংলাই। বাড়ি-ঘর রাস্তা-ঘাট পার্ক-হল নতুন নতুন কত কি যে হয়েছে, হচ্ছে। হয়তো এমনটাই হওয়ার কথা ছিল, আমরা বুঝিনি। বুঝতে পারিনি।

প্রোমোটারদের থাবায় শুধু কলকাতাই নয়, এখন সারা বাংলাটাই আটকে পড়েছে। নেতা মন্ত্রীরা বলছেন প্রগতি, হঁ হঁ আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝছি, কেমন করে বাংলাটা বাঙ্গালীদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা আর কোথাও নেই রে শন্তু, না বাণিজ্যে, না ব্যবসায়, না চাকরিতে, না উৎসবে, না আয়োজনে, হঁ, যাদের টাকা আছে অঢেল, তারা কেমন অনায়াসে সাম্রাজ্য গড়ছে আমাদের বুকের ওপর দিয়ে। এখানে দু চারটে দিন থাক বুঝতে পারবি।

স্যারের বাড়িটা তো জানিস, দারুণ জায়গায় ছিল।এই গঙ্গার বাঁকের পাড়ে চারদিক খোলা এমন লোভনীয় জমি লোভ তো হবেই। একসময় শুরু হলো স্যারের জমিটা কিনে নেওয়ার জন্য চাপাচাপি। স্যারকে তো জানিস এক কথাই না বলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "চার পুরুষের ভিটে আমার, কোটি টাকাতেও হাতছাড়া করব না। আর টাকা নিয়ে কি করবো আমি? একা মানুষ, সপাকাহার করি। পড়াশুনা ছাড়া আর কোন টান নেই জীবনে, কি হবে বাড়ি বেচে? তাছাড়া যাবোই বা কোথায়?" কথাই যখন হলো না তখন শুরু হলো অন্য উপায় উচ্ছেদের চক্রান্ত। দিনের পর দিন কি দুঃসহ যন্ত্রণা যে স্যারের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল, আমরা নিরুপায়ের চোখে দেখেছি। রাজনীতির বড় বড় দাদারা, যাদের আশ্রয় আর প্রশ্রয়ে প্রোমোটার চক্রের জন্ম ও বিকাশ, তারাও লেগে পড়ল স্যারের পেছনে। বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, সেসময় চোখটাও গিয়েছিল খারাপ হয়ে। খুব একটা ছাত্র পড়াতেও আর পারতেন না, শরীরটাও ভেঙ্গে পড়েছিল, একদিন আমাকে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, "আমি কি তোমাদের জন্য কিছুই করিনি? আমাকে উচ্ছেদ করে তাড়িয়ে দিতে চাইছে একদল অর্থলোভী পিশাচ, তোমরা, আমার ছাত্ররা কি পারো না একটু রুখে দাঁড়াতে?" স্যার বলছিলেন আর কাঁদছিলেন। সন্তু, আমরা সত্যিই পারিনি। ছাপোষা কেরানী সাধারণ মানুষ আমরা, এই বিরাট পাপ চক্রের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিরোধ করা আমাদের সাহসে কুলোয়নি। তাছাড়া তোর কাছে স্বীকার করতে বাধা নেই সন্তু। আমরাও আসলে যে যার নিজের নিজের জীবন যাপনের সমস্যা নিয়েই এত জেরবার হয়ে থেকেছি, চারপাশে ছাটাই, লে অফ, লক আউট, ভি আর এস, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম, অসুস্থতায়, বিপন্নতায়, দিশেহারা হেলপ্লেস। আমরাও স্যারের ব্যাপারটাই ঢুকিনি, ঢুকতে চাইনি। স্যারকে তো জানিস। জীবনে চাকরি করেননি, অন্যের হুকুম শুনতে হবে বলে। কারো কাছে মাথা নত করার মত মানুষ তিনি ছিলেন না। সেবার অঘ্রান মাস। ঘন শীতের রাতে, হঠাৎ হই হট্টগোলে ঘুম ভেঙে গেল। বারান্দায় এসে দেখি বকুলতলার আকাশ দগদগে লাল। লোকজনের প্রচন্ড চেচামেচি, আর্তনাদ। আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। ছুটে পথে নামলাম। সন্তু, সেই দৃশ্য তুই ভাবতে পারবিনা। দাউদাউ করে জ্বলছে স্যারের ভাঙ্গাচোরা বাড়ি। পাড়ার লোকেরা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আগুন থেকে তারা শুধু অবনী স্যারকে বাইরে আনতে পেরেছিল। স্যারের প্রাণের ধন শতশত বই ওই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুক ফাটানো আর্তনাদে স্যার বলছিলেন, "ওরে বইগুলো বাঁচা, বইগুলো বাঁচা।" নারে সন্তু, আমরা বাঁচাতে পারিনি। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসতে লাগলো।"

বললাম, "অপূর্ব চুপ কর, চুপ কর।" হিরোশিমায় যে দিন বোমা পড়েছিল, সেদিনটার গল্প স্যার আমাদের বলতেন। কেমন করে একটা বিশাল আগুনের গোলা প্রচন্ড বুক ভাঙ্গা শব্দ নিয়ে লক্ষ্য লক্ষ্য প্রাণকে ধ্বংস করে মুহূর্তে উঠে গিয়েছিল নীল আকাশে। স্যার বলতেন, আর দেখতাম ক্ষোভে কষ্টে স্যারের চোখ ছল ছল করে উঠত। ভাবতেও পারছি না নিজের চোখের সামনে এই এক হিরোশিমা তিনি কী করে দেখলেন? কি করে সহ্য করলেন? চোখ জলে ভরে এল আমার।

অপূর্ব বলল, "সন্তু স্যার এখনো বেঁচে আছেন। মারা যাননি। যাবি? স্যারের কাছে?"

আমি কেঁদে ফেললাম। না, পারবোনা। আমরা–আমরা কি রকম মানুষ অপূর্ব? স্যারের কাছে রসদ নিয়ে বড় হলাম, বড় চাকরি করলাম, বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে রইলাম। স্যারকে কি ফিরিয়ে দিলাম? কি?

"চল সন্তু। দেশে যখন এসেছিসই, স্যারের সামনে গিয়ে একবার দাঁড়াই।"

সন্ধ্যেবেলায় ইস্কুলে গেলাম, ছেলেবেলার স্কুল। এখন অনেক বড় হয়েছে। দারোয়ানের ঘরের পেছনে আর একটা টালির ঘর, যেখানে আগে থাকত ঘুটে কয়লা, সেই অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে বিছানার ওপরে একটা মানুষ। শীর্ণ পোড়া কয়লার মত ফ্যাকাশে। বসে আছেন। আমাদের অবনী স্যার। স্যার, পায়ে হাত রেখে প্রণাম করে কেঁদে পড়লাম। স্যারের কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। অপূর্ব আমায় ধরে তুলল। শোন, স্যার বেঁচে আছেন, কিন্তু কোন বোধশক্তি ভাষা কিছুই আর নেই। বুক আমার ভেঙে যাচ্ছে। সমস্ত চেতনা জুড়ে কান্না নামছে। নিজের ওপর ধিৎকারে, গ্লানিতে, রাগে, বিরক্তিতে চুরমার হয়ে যাচ্ছে হৃদয়। স্কুলের দারোয়ান রামসিং স্যারকে এনে রেখেছিলো, জায়গা দিয়েছিল। আমায় চিনতে পেরে বলল, "দাদা দুঃখ করোনা, যার যা কপাল। চুপ করে যাওয়ার আগে বলতেন যার যা কাজ সেটা ঠিক করে করাটাই ধর্ম। আমার কাজ ছাত্র গড়ে তোলা, সেটাই করি। আমি ধর্ম পালন করি। এই যে দাদা তুমি এতদুর থেকে স্যারকে দেখতে এলে, এও তোমার ধর্ম। মন খারাপ করোনা।" স্যার বসে আছেন, শূন্য দৃষ্টি। মনে হল তিনি বলছেন, "বুঝলি? নিজের কর্তব্য করে যাওয়াটাই জীবন। এই যেমন আমি তোদের এত কিছু বলি, এতসব শেখায়, তোরাও বড় হয়ে অন্যকে শেখাবি। অন্যকে বড় করে তুলবি। এই তো মানুষের কাজ।" স্যার বলে যাচ্ছেন। কষাঘাতের মত এক একটা বাক্য এসে পড়ছে আমার শরীরে। স্যারের গাওয়া গান মনে পড়ছে, 

"আরো আরো প্রভু আরো আরো,

আরো আরো প্রভু আরো আরো।

এমনি করে এমনি করে আমায় মারো।

আরো আরো প্রভু আরো আরো,

আরো আরো প্রভু আরো আরো।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !