বিসর্জন ...
লেখক : স্বরূপ সী।
সেদিন বেশ মেঘ করেছিল, বাড়ি ফেরার তাগিদও ছিল, নাহলে আবার মা বকবে। সেই ভয়ে তাড়াহুড়োর মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ঝড়বৃষ্টির প্রোকপে আটকে পড়ি। দেখি খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছে আর কোথাও যাবার ঠাঁই না পেয়ে, পাশের পাড়ার মনসুরদার বাড়ি, সেখানে গিয়ে আপাতত উঠলাম।
বাড়িতে কাউকে না দেখতে পেয়ে চেচিঁয়ে বললাম মনসুরদা বাড়িতে আছো নাকি?,তেমন গলার আওয়াজ না পেয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।মনসুরদা দেখি কীসব লিখতে ব্যস্ত, মনসুরদা আমায় দেখে বলল, 'কীরে, এত মেঘ ঝড়ের দিনে কোথায় যাচ্ছিলি?'
কাঁদোকাঁদোভাবে বললাম, 'বাড়ি'।
'এত বৃষ্টি পড়ছে কীভাবে যাবি?এখন থেকে যা'।
বাড়ি ফেরার নেশায় বললাম, 'মা খুব চিন্তা করবেগো মনসুরদা'।
মনসুরদা আমার পাশে এসে বলল, 'ঝড়বৃষ্টি না থামা অব্দি তোকে গল্প শোনাই কেমন?'
বেশ খুশি হয়ে বললাম, 'আচ্ছা বেশ, শোনাও'।
মনসুরদা লেখালেখি ছেড়ে, তার গল্প বলা শুরু করে দিল ...
'আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতায় ছিলাম, বেশ অচেনা মানুষ, ব্যস্ত জীবন, স্বপ্ন নিয়ে কলেজে সবে পা রাখলাম।অচেনা শহর! বাড়ি ভাড়া করে থাকার মতো টাকাও ছিল না।উপায় না পেয়ে কলেজের হস্টেলে থাকা শুরু করি, বিভিন্ন রকমের মানুষের সাথে পরিচিতি হয়েছিল।সবকিছুর মধ্যে গোটা ফ্রাস্ট ইয়ারটা এক পলকে কেটে যাচ্ছিল তাও কোথাও যেন অনেক ভিড়ের মাঝে নিজের সবটা আত্মপ্রকাশের জন্য একজনের অভাব অনুভব করতাম।ঠিক ফ্রাস্ট ইয়ারটা শেষে, হস্টেলে অর্নবের সাথে আলাপ হয়।সেই সবে অর্নবের ফ্রাস্ট ইয়ার, তবে ছেলেটা অন্যদের থেকে কিছু আলাদা ভাবত।
একদিন অর্নব রুমে বসে কাঁদছিল, সেই দেখে ভাবলাম বাড়ি থেকে নতুন এসেছে তাই বাড়ির লোকের জন্যে মন কেমন করছে হয়ত। আমার এই অসময়ের উপস্থিতিটা অর্নবের ভালো লেগে গিয়েছিল।এভাবে ধীরে ধীরে একে অপরের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলাম। দিন যত এগোতে লাগল, আমাদের বন্ধুত্বের বাধঁন আরও পরিনতির দিকে এগলো। চারিদিকের ভিড়ের মাঝে শুধু অর্নবকে জুড়ে আমার পৃথিবী গড়ে উঠেছিল। অর্নব বেশ ভালো গান গাইত, আর আমার কবিতাও ওর পছন্দ ছিল। মনে হয়েছিল জীবনের বাকী দিনগুলো এভাবেই যেন ভেসে যাই।ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমনো পর্যন্ত কথা শেষ হত না, বরং মনে হত কিছু অবশিষ্ট থেকে গেল।তাও কোথাও যেন দুজনের এভাবে মিশে যাওয়াটা হস্টেলে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এভাবে চলার পর চারটে বছর কেটে যায়, তারপর দুজনের জীবন উলটপালট। চাকরী সুত্রে আমাকে কলকাতা ছেড়ে মুম্বাই চলে যেতে হয়।
সাজানো জীবনের সুরের ছন্দটা সেদিন দুটো জীবনকে বিরহের গান শুনিয়েছিল। চারবছর কেটে গেল,অর্নবের সাথে যোগাযোগ প্রায় না থাকার মতো ছিল। তখন আমার বয়স ছাব্বিশ বছর সেই সময় আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করে দেন ফতিমার সাথে। একদিন হঠাৎ ফোন আসে অজানা এক নাম্বার থেকে স্তব্ধ সুরে বেজে উঠল, 'অর্নব আর নেই'।
এটা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, বুকের ভিতরে কেউ যেন সজোড়ে হাতুড়ি মেরে দিয়ে গেল। কষ্টের পাহাড় নিয়ে বিলম্ব না করে ট্রেন ধরে রওনা দিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখি সন্তান হারার কষ্টে এক মা কান্নায় ফেটে পড়েছে, সেদিন আর আমার কবিতাগুলো সারা শরীরে যন্ত্রনা হয়ে ঝরে পড়ছিল। কেউ একজন কানে ফিস ফিস করে বলে গেল মাঝ রাতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। হঠাৎ সেই সময় অর্নবের মা তার পাঞ্জাবি পকেটে পাওয়া একটা চিঠি আমার হাতে তুলে দিলেন। চিঠিটা খুলতেই দেখি ...
"প্রিয় মনসুরদা,
আর একটা সকাল দেখার জন্য নিজেকে বাচিঁয়ে রাখতে পারলাম না।কোন ছোটোবেলায় বাবা কে হারিয়েছি, জীবনটা একাই কেটেছে ঘরের এক কোনে। নিজেকে লুকিয়ে এক নারীর রুপ দেওয়ার কতই না চেষ্টা করেছি জানো মনসুরদা,পারিনি নিজেকে আটকে রাখতে। আমার দেহ মন জুড়ে ছিল একটা মেয়ে, সমাজের চোখে এক পুরুষের আবরনে মোড়া নারীর মনকে আগলে এসেছি এতদিন ধরে। তোমার সাথে আমার ভালবাসার দিনগুলো বেশ মধুর ছিল, আমার ভিতরের মনের ভালোবাসার সম্মান জানিও। আমার শেষ ইচ্ছে প্রেমিকার বেশে গঙ্গার জলে ভেসে যেতে।
ইতি,
তোমার অর্ণব "
সেদিন ছিল দশমী, দুর্গা মায়ের বিসর্জন, বরন করা শুরু। অর্নবকে সেদিন শাড়িতে কি সুন্দর লাগছিল! চোখে কাজল, গলায় রজনিগন্ধারমালা আর পায়ে আলতা, সেজে গুজে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী অর্নবের দেহটাকে কলার ভেলায় তুলে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিল, আর বলে উঠল, 'বলো হরি, হরিবল'। আমি গঙ্গার তীরে ভেলার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আযানের ডাকে ভোর হল, সেই সময় কালিকাপ্রসাদের 'বন্ধু তোর লাইগা রে ...' গানটা কানে বাজচ্ছিল। মায়ের সাথে অর্নবের বিসর্জন হয়েগেল।সেদিনের যন্ত্রণা সাড়া দিয়ে উঠলেই ফতিমার মধ্যে আজও অর্নবকে খুঁজে বেড়াতে থাকি।''
সেই সময় দেখি মনসুরদার চোখে জল, ভিতর থেকে তার মনটা দুমড়ে মুছড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ক্ষীণ স্বরে বলল 'এটা গল্প হলেও সত্যি'।
বৃষ্টি থেমে গেল। আমিও বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
Please do not enter any spam link in the comment box.