জঙ্গলের বিভীষিকা (প্রথম পর্ব)


প্রথম পর্ব

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নবীন হাত ঘড়িটা একবার দেখে নিল। ট্রেন আসতে দশ মিনিট বাকী। ডান হাতে পতাকা ধরা। এই মাস তিন হল সে স্টেশন মাস্টারের চাকরি নিয়েছে। চাপ বেশি থাকে না।ভিড়-ভাট্টাও নেই। ট্রেনটা স্টেশনে ঢুকেই একবার হর্ন দিয়ে বেড়িয়ে গেল। সে অফিসে ঢুকে দেখে সুজিত বসে আছে। সুজিত এইখানকার ই ছেলে। বেশ সাহসী, শরীরস্বাস্থ্য ভাল।সময় পেলেই গল্প করতে আসে।দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমে গেছে।

এই গ্রাম সম্বন্ধে নবীন তেমন কিছুই জানে না।গ্রামটা ঘুরে দেখায় হয়নি তার। সকাল আর দুপুর ট্রেন আসে। বাকি সময় অফিস ঘরেই থাকে, একা।

নবীন তার কাঠের চেয়ারে বসে বলে, "বাঁচালে, এই নিঃসঙ্গতা আর ভাল লাগে না।"

সুজিত বলে, "একটা খবর জানাতে এলাম তোমাকে, কথাটা শোনার পর তোমার এ ব্যাপারে কি মতামত সেটা জানাও।খবরটা যখন আমি প্রথম শুনলাম খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। অবশ্য দেওয়ার কথাও নয়, তারপর...। আচ্ছা থাক ঘটনাটা তোমাকে প্রথম থেকেই বলি, এটা প্রায় ১০-১২ দিন আগের কথা, গোয়ালা এসে একদিন বলল, সে আর দুধ দিতে পারবে না।কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলল, তার গাই আর বাছুরটাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে মাঠে বেঁধে এসেছিল, বেলা করে আনতে গিয়ে দেখে সেখানে নেই। অনেক খোঁজা খুঁজির পরও পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার পরপরই কারোর ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি চুরি যেতে থাকল। ব্যাপারটা কেউই বুঝে উঠতে পারল না, এমন ঘটনা তো আগে কখনও হয়নি, এই প্রথম। তাই জনা কতক মিলে একদিন খোঁজা খুঁজি শুরু করে দিল। গ্রামের বাইরে জঙ্গলটার কাছে গিয়ে দেখল, ওই দিকটায় কতগুলো ছোট ছোট ঝোপ কেমন যেন মাটির সাথে মিশে গেছে। লতা-পাতার দল ছিঁড়ে শুকিয়ে পড়ে আছে। ওরা এগোতে গিয়েও আর এগোতে পারল না। সামনে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে মাংস সমেত হাড়, মুরগির পালক, রক্ত। পচা গন্ধে তারা বমি করে ফেলল।গ্রামের লোকে ভাবলো, হয়তো জঙ্গলে কোনো বড় শেয়াল টেয়াল এসেছে। জঙ্গল থেকে বসে এদিকে নজর রেখেছে আরকি। তাই সবাই মিলে ঠিক করল যে পাহারার ব্যবস্থা করা হবে। সে কথা অনুযায়ী দলও তৈরি করা হল, পাহারাও শুরু হল। কদিন বেশ স্বাভাবিক চলছিল, গত চারদিন থেকে ঘটনাটা একটু বদলেছে। তবে এবার আর পশু পাখি নয় মানুষ নিখোঁজ হচ্ছে। তারপর দলে আরো লোক বাড়ানো হল। মশাল, টর্চ তো ছিলই এর সাথে সাথে লাঠি ,সড়কি,কাটারি রাখা হল অস্ত্র হিসাবে।কিন্তু,গতকাল আবার সেই ঘটনা, আবার দুজন একসাথে নিখোঁজ হল দলের।আতঙ্কের পারদ এখন চরমে। সন্ধের পর এক পাও বাড়ির বাইরে বেড়নোর সাহস নেই কারোর।"

নবীন বলে, "বলো কী? পাহারায় গেছ নাকি?"

"না, এখনো যাইনি। তবে আজ যেতে হবে।তাই একবার দেখা করতে এলাম। বলা তো যায় না কী হয়।যাবে নাকি?"

কিছুক্ষণ ভেবে নবীন জিজ্ঞাসা করে, "কত জন থাকবে পাহারায় ?"

"পঞ্চাশ জন তো হবেই। এক একটা দলে দশ জন আছে, এরকম পাঁচটা দল। ভোর হলেই আবার ফিরে আসব।"

নবীন ভাবে ট্রেন সেই কাল সকাল আটটা তিরিশে আসবে, এমনিতেই অফিস ঘরে একা থেকে থেকে জীবন অবসাদে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত। দুঃসাহসিক অভিযানে গেলে মন্দ হয় না। সুজিত কে বসতে বলে সে একটা পিঠ ব্যাগে জলভর্তি বোতল, টিফিন বক্সে কিছু মুড়ি আর টর্চটা ভরে নিল। অস্ত্র হিসাবে নিল অফিস থেকে দেওয়া একটা পিস্তল, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে।

অফিসের গেটে চাবি দিয়ে দুজনে বেড়িয়ে পড়ল।সন্ধ্যা নেমেছে। গিয়ে দেখে গ্রামের লোকেরা তির-ধনুক, বল্লম, বড় বড় ছুরি, দা, টাঙি, বাঁশের লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে। তবে দু'তিনটে  বন্দুকও আছে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে কে কোন দলে থাকবে আর কোন দিকে যাবে। বাঁশ কেটে তাতে কাপড় জড়িয়ে মশাল তৈরি করেছে। কেরোসিনের ড্রামও সাথে আছে।ঠিক হল দশ জন করে দল হবে। কিছুটা দূরে দূরেই দলগুলো থাকবে। বিপদে এক দল অন্য দলকে সাহায্য করবে ।

প্রতিটা দল নির্দেশ মতো এগিয়ে চলল। মশাল জ্বলছে সবার হাতে। বিশাল এক আগুনের দেওয়াল যেন গ্রাম আর জঙ্গলটার মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।দলের লোকেরা নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা বলছে।ঝি-ঝি ডাকছে। কালো মেঘের দল, মাঝে মাঝেই চাঁদ আড়াল করে দিচ্ছে। অল্প আলোয় সামনের জঙ্গলটা বেশী রহস্যময় লাগছে। গাছ গুলো যেন হঠাৎই আকাশ ছোঁয়া বড় হয়ে উঠেছে। জঙ্গলের ভিতর হতে একদল শিয়াল ডেকে উঠলো। দলের একজন বলল," দুটো দল জঙ্গলে ঢুকলে ভালো হয়। সেই রকম কিছু দেখলে আগে থেকে সতর্ক হওয়া যাবে। আর আমাদের দিক থেকে আক্রমণটাও জোরালো হবে। "নবীনদের দল এগিয়ে গেল, পেছনে আর একটা। নবীন টর্চ লাইটটা বাগিয়ে ধরেছে। মশাল জ্বলছে। বাইরে থেকে জঙ্গলটাকে যতটা ঘন দেখায় ভেতরটা তেমন নয়।ফাঁকায় ফাঁকায় আছে গাছগুলো। নবিনরা খানিক ভিতরে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে একটা মশালের লাঠি, তাতে আগুন নেই। নবীন টর্চের আলোটা সামনের দিকে ফেলল। একটা জামা, সেটা ছিঁড়ে গাছের ডালে আটকে আছে। পাশে মাংস সমেত হাড়।রক্তে মাটি ভিজে। প্রত্যেকে সতর্ক হয়ে যায়।পেছনের দলকে হাঁক দেয়। একজন এগিয়ে আসে ,জামাটা চিনতে পারে। "এতো নগেনের জামা, নগেন তো আজই পাহারায় এসেছে।" শুনে প্রত্যেকেই চমকে গেল। নবীনের গা গুলিয়ে উঠল। রক্তটা টাটকা। একটু আগেই শয়তান নগেনের দেহটাকে কামড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে। প্রত্যেকে মশালে তেল ঢালে। মশাল দাউ-দাউ করে জ্বলে ওঠে। সবার মাথায় খুন চেপে গেছে। আজ এর শেষ দেখে তবে ছাড়বে। পাঁচ জন-পাঁচ জন করে দলে ভাগ হয়ে গেল। তির-ধনুক, লাঠি, বন্দুক সব শক্ত করে ধরে এগিয়ে চলল। একটা গম্ভীর শব্দে জঙ্গলের পাঁজর কেঁপে উঠলো। পুরো জঙ্গলটা নড়ছে। তাজা রক্তের নেশা তাদেরকে মাতাল করে দিয়েছে। মেঘ ডাকছে, ঝড় উঠেছে।চোখ খোলা রাখা যায় না। সবাই মশালে বেশী করে তেল ঢেলে নিল।বৃথা চেষ্টা!, খানিক পরেই বৃষ্টি নামল। অল্প সময়ের মধ্যেই সব অন্ধকার। কে কোথায় আছে বোঝা যাচ্ছে না। সুজিত বলে উঠল, " নবীন, টর্চটা নেভানো যাবে না ওটা জ্বালিয়ে রাখো।"

দলের একজন বলল, " আমাদের জঙ্গলের বাইরে বেরোতে হবে, এগিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না ।" 

আর বেরোতে গিয়েই সমস্যাটা বাড়ল। কোনদিকে যাবে? টর্চের আলো বৃষ্টির ফোঁটা কাটিয়ে বেশীদূর যেতে পারছে না। তারা সামনের গাছটাকে পেছন করে এগোতে লাগলো। ঝড় কমে বৃষ্টি পরছে বেশী করে।মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিছুদুর যাওয়ায় পর সুজিত বলল, " কী ব্যাপার ? এতক্ষনে তো আমাদের জঙ্গলের বাইরে বেড়িয়ে যাওয়ার কথা। গোলকধাঁধাঁয় আটকে পড়লাম নাকি?"     

একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল। সাথে একটা গর্জন।কী হতে পারে এটা ? আগে তো কেও এমন ডাক শোনেনি। তাদের কৌতূহল পেয়ে বসল।নবীন টর্চের আলোটা সেই দিকে ফেলে। কিছু দেখা যায় না।সাথে সাথে সুজিত বন্দুক চালায়। গর্জনটা বেড়ে উঠেছে। "লেগেছে।"পরপর গুলি চালায় সে। অন্যরা হত বুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে। কী করবে বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি কমে আসছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সুজিত বলে," চলো এগিয়ে যাওয়া যাক। "সামনে সুজিত পরে নবীন। পেছনে অন্য তিনজন সামনের জনকে অনুসরণ করে চলেছে। একটা বুনো গন্ধ তাদের নাকে এল। সুজিত  চুপি চুপি বলল, "সাবধান ,শয়তানটা  মনে হচ্ছে আশে পাশেই কোথাও লুকিয়ে আছে।" 

তারা একবার দাঁড়িয়ে গেল। কি মনে হতে নবীন  টর্চের আলোটা সুজিতের সামনে থেকে সরিয়ে পেছনের তিন জনের দিকে ফেলে। টর্চের অল্প আলোয় তারা যা দেখল, তা যেকোনো ব্যক্তির হৃদগতি থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাদের হাত পঁচিশের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।

এ-এটা কী? মানুষ? নাকি অন্য কিছু?

শরীর পুরো লোমে ঢাকা। হাতের আঙুলে বড় বড় তীক্ষ্ণ বাঁকানো নখ। রক্ত ঝরছে। নবীনের চোখ সেটার মুখের দিকে স্থির।মুখটা কোনো মানুষের না, নেকড়ে বা হিংস্র কোনো জানোয়ারের। বড় বড় ছুঁচলো দাঁত চক চক করছে। রক্ত লোলুপ লম্বা জিভটা লক লক করে মুখের চার দিকটা চেটে নিচ্ছে। এক ফোঁটা রক্ত সে নষ্ট হতে দেবে না। নবীন চোখের দিকে তাকায়।

এ-কী!এর চোখ কোথায়? চোখ কি আদৌ আছে নাকি নেই ? - আঁতকে ওঠে।

মণিহীন এক জোড়া চোখ এক দৃষ্টে তাকিয়ে। বিশ্রী একটা গড় গড় শব্দ বেড়িয়ে আসছে সেটার মুখ থেকে।নবীনের সারা শরীর কাঁপছে।বুনো গন্ধে মাথা বোঁ-বোঁ করছে। টর্চটা হাত থেকে খসে পড়ল কাদা জলে।অজান্তেই, জানোয়ারটার দিকে তাক করা পিস্তলটা গর্জে উঠল। সাথে সাথে একটার পর একটা তীর সেটার বুকে আর পেটে গেঁথে দিল। সুজিত অনেকটা সামনে এগিয়ে এসেছে। হাতে বন্দুক ধরা। কিছু একটার অপেক্ষায় আছে সে। এরপর জানোয়ারটা যা করল সেটার জন্য কেও প্রস্তুত ছিল না। একবার গর্জে উঠেই নবীনের দিকে দৌড়ে এল। সামনে কারোর উপস্থিতি যেন টেরই পেল না। সুজিত কিছু বুঝে উঠতে পারল না।ট্রিগারে চাপ দেয়। লাগল কী?

আচমকাই জানোয়ারটা দিক পরিবর্তন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুজিতের ওপর। মেঘ ডেকে উঠল। কাছেই কোথাও বাজ্ পড়ল। নবীন দেখল, সুজিতের ঘাড়টা নীচে ঝুলে পড়েছে। রক্ত ফিনকি দিয়ে উপরে উঠছে।রক্ত লোলুপ শয়তানের জিভটা কাজ করে চলেছে নিপুণ ভাবে। নবীন চোখ বন্ধ করে নিল।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ফুসফুস দুটো পাঁজর ভেঙে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। 

"আর-আর এখানে না"- সে বাকিদের পেছন করে ছুটতে লাগল। বেঁচে থাকার আশা তাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে চলছে।

চারিদিক অন্ধকার, ঝি-ঝির ডাক রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ফেলছে। আকাশে তারারা এ দিকেই মিট মিট করে তাকাচ্ছে। এক ঝাঁক জোনাকি পাশের ঝোপটার উপর স্থির হয়ে আছে।নবীনের হাতটা  একবার নড়ে উঠল।ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরছে। " আ..."।

মাথার পেছনটা টন টন করছে।হাঁটু গেড়ে বসল। শার্ট প্যান্ট, কপাল, মুখ কাদায় ভর্তি।মাথার চুল থেকে কাদা জল টপ টপ পড়ছে।

- "আ..., অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।" 

চোখ খোলে সে। চাঁদের আলোয় বেশ দেখা‌ যাচ্ছে, সামনে একটা নদী। পাড়ে নৌকা বাঁধা। হুঁ- হুঁ করে পেঁচা ডেকে উঠলো। ঝি -ঝি একভাবে ডেকেই চলেছে ।নবীন উঠে দাঁড়াল। পায়ের তলার কাদা মাটিতে পা আটকে আছে।গায়ের শার্টটা খুলে মাথাটা একবার মুছে নিল।

হঠাৎই একদল শিয়াল ডেকে উঠল। নবীন চমকে উঠে, শার্টটা ফেলে কোনোরকমে দৌঁড়াতে লাগল সামনের নৌকাটার দিকে। তাকে এখন থেকে পালাতেই হবে।সে গিয়ে উঠল নৌকায়। নৌকার দড়িটা খুলেই ধপ করে বসে পড়ল। বহু কষ্টে দাঁড় টানতে লাগলো। এই একবার - দু'বার -তিনবার। আর পারছে না। চোখ বুজে এল।অদৃশ্য দানব যেন তার সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !