মূল্যবোধ


লেখক: ডাঃ হর্ষময় মণ্ডল


     অচিন্ত্য স্কুলের সহকারি শিক্ষকের পদে চাকরি করেন। চাকরির ক্ষেত্রেও বেশ দূরে আসা-যাওয়া প্রায় এক'শো কিলোমিটার। প্রত্যহ যাতায়াত করেন বাসস্থান থেকে বাসে, ট্রেন। সকালে মুহূর্ত সময় নেই। সাড়ে পাঁচটায়  ঘুম থেকে ওঠেন। কোষ্ঠকাঠিন্যের ধাত। তিন-চারবার যাওয়ার পর কোষ্ঠ কিলিয়ার হয়। তারপর প্রাণায়াম, সেভ করা, স্নান, পূজা, খাওয়া সেরে পৌনে ন'টায় বাসে এই সকালে যদি সবজি মাছের বাজারে যেতে হয় চাপেন। যেদিন সবজি বাজার বা মাছ কেনার থাকে সেদিন সাড়ে সর্বনাশ। তখন প্রাণায়াম ও সেভ করা বাদ দেন। সেই রকমই দিনটি হলো আজ। হন্তদন্ত হয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় কিন্তু সময় যেহেতু কম সেহেতু মোটরবাইক। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূরে দেখলেন দিক থিকে ভিড়। ফিরে যাওয়ার রাস্তা নেই। ভাবলেন সামনেই বিয়ে বাড়ি হয়তো তার লোকজন ।অগত্যা দাঁড়াতে হলো। ভিড়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে ভাই?

- একটি যুবক জবাব দিলেন, একটা ভিখারী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। বেঁচে আছে না মারা গেছে বোঝা যাচ্ছেনা।

- সে কি আপনারা কেউ দেখেননি? মুখে চোখে জল দিন।

- ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর একজন ভদ্রলোক বললেন, কে রিকস নেবে দাদা! ছুঁলেইতো ছত্রিশ ঘা। পুলিশ জিজ্ঞাসা করবে কে দেখেছে, কে মেরেছে, কি করে হলো নানান হ্যাপা। কি দরকার। অচিন্ত্য অবাক হয়ে গেলেন জবাব শুনে। মনুষ্যত্ব, মানবিকতার মানুষের মন থেকে কি উধাও হয়ে গেলো? যারা এখানে আছেন সকলেই অল্পবিস্তর চেনা কিন্তু আজ আর চেনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কতগুলো ভেড়া দাঁড়িয়ে আছে। বললেন, ছাড়ুন, ছাড়ুন দেখি কি হয়েছে! দেখলেন কাত হয়ে পড়ে আছে একটি লোক কপালে চোট পেয়েছে অল্প রক্ত বের হচ্ছে। লোকটিকে চিত করে বললেন, কেউ একটু জল দিন ভাই। মুখে জলের ঝাপটা দেবো।

     একজন জল এনে দিলেন।

- অচিন্ত্যবাবু মুখে জলের ঝাপটা দিলেন। তার আগেই দেখে নিয়ে ছিলেন বেঁচে আছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে। যত্নসহকারে কপালের রক্ত ধুয়ে দিলেন। তারপর মনে হলো তার চেনা। কিন্তু মনে করতে পারছেন না এখনও জ্ঞান ফেরেনি।  ভিড়ের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করলেন কি করে হলো?

     কেউ কোন জবাব দিলেন না।

     বিয়ে বাড়ির প্যান্ডেলের সামনে হল তারপর পথচলতি লোকজন কেউ দেখল না? অসীমদার মেয়ের বিয়ে। অসীমদা বাড়িতে আছে একবার কেউ ডাকুন, বলুন অচিন্ত্য বাবু ডাকছেন।

     কেউ কোন জবাব দিলেন না, ডাকতে গেলো বলে মনে হলো না।

     বারকয়েক জলের ঝাপটা পর আস্তে আস্তে চোখের পাতা খুললেন আবার বন্ধ করে দিলেন। অচিন্ত্য বাবু চিনতে পারলেন আরে এ তো পবিত্র ভট্টাচার্য আমাদের সাহিত্য পরিবারের সাথে যুক্ত ছিলেন কবিতা লিখতেন নিজের অজান্তেই ডেকে ফেললেন,  পবিত্রদা? আপনি ঠিক আছেন? এখন কেমন বোধ করছেন?

     ভিড়ের সবাই পরস্পর আলোচনা শুরু করে দিলেন। আলোচনা কলরবে পরিণত হলো। অচিন্ত্য বাবু বললেন, আপনারা দয়া করে চুপ করুন। 

- ভিড়ের মধ্যে একজন বললেন, মাস্টার মশাই আপনি এই ভিখারীটাকে চেনেন?

- চুপ করুন! কাকে  ভিখারী বলছেন? ইনি ভিখারী নন। আমি চিনি ইনি পবিত্র ভট্টাচার্য। একবার চোখ খুলে আবার বন্ধ করে নিলেন। আবার চোখ খুললেন অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি অচিন্ত্য।

- হ্যাঁ পবিত্রদা, আমি অচিন্ত্য। কিন্তু আপনি এখানে এই অবস্থায়?

- খাবার সন্ধানে।

- খাবার সন্ধানে ?

- আমার তো আর কিছুই নেই, তাই যেখানে যা পাই তাই খেয়ে পেট ভরাই। আমার এলাকার সবাই চিনে গেছে সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। তাই খাবার অন্বেষণ করতে করতে এতদূর এসে পড়েছি। আজ তিন দিন খাইনি ।এখানে দেখলাম বিয়ে বাড়ি  সকালের জলখাবার হচ্ছে তাই খেতে চাইলাম। বললো,  এই জলখাবার তৈরি হচ্ছে এখনো কেউ খায়নি আর ভিখারীকে দিয়ে শুরু করবো? বের হয়ে যা , ফেরো বলছি।আমি যাইনি। একটা ছেলে আমাকে ধরে হিড় হিড় করে টেনে রাস্তায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। তারপর কিছু মনে নেই।

     মুহূর্তে মনে পড়ে গেল অচিত্ত্যবাবুর পবিত্র ভট্টাচার্যের ফেলে আসা জীবন।


-------------


     আমাদের একটি সাহিত্য পত্রিকা আছে তারই প্রত্যেক সপ্তাহে রবিবারে সাহিত্য আড্ডা বসতো দুর্গাপুর ব্যারেজের বকুলতলায়। একদিন হঠাৎ করে পবিত্র ভট্টাচার্যের আবির্ভাব। নতুন মুখ অনেক আসে দূর-দূরান্ত থেকে। কারণ এই আড্ডার কথা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। -পবিত্র ভট্টাচার্য্য বললেন,  আমি কবিতা লিখি। একে একে সকলে পড়ছে পবিত্রর পালা এলো পড়লেন মুগ্ধ  করার মতো কিছু নেই। বলতে পারা যায় বাচ্চাদের মত লেখা, অথচ নিজের কবিতার প্রতি ভীষণ গর্বিত। যাইহোক সংযোজিত সম্মার্জিত করে বৎসরে যে চারটি পত্রিকা ছাপা হয়  তাতে উনার লেখা এক-দুটি পত্রিকায় ছাপা হয়। বলে রাখা ভালো সকলের আর্থিক সহযোগিতায় ও এডের টাকায় পত্রিকা চলে। কিন্তু পবিত্র সব জানা সত্ত্বেও একটা টাকাও কোনদিন দেননি, অথচ উনার আর্থিক অবস্থা ভালো। নিজে ডি.পি.এল এ চাকরি করেন।

     পরে জানতে পারা গেলো পবিত্রর অত্যধিক কৃপণতার জন্য বিবাহিতা স্ত্রী পবিত্র কে ছেড়ে সাথে নিজের একমাত্র ছেলেকে সাথে নিয়ে চলে গেছেন। সেই তখন থেকে আর কোন যোগাযোগ নেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। স্ত্রী মৌলি কোন এ্যালিমনি পবিত্রর কাছে ক্লেম করেননি। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর একটি মেয়েকে নিজের কাছে রক্ষিতা রেখেছে। নাম বিদ্যা। যদিও বিদ্যার ধারে কাছে নেই। নিজের নাম টুকু কোন রকম লিখতে করতে পারে।

     ক্রমে সময় গড়িয়েছে। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বুড়ো হয়েছেন। যে রক্ষিতা টি ছিল সে দাবি করল আমাকে দশ লাখ টাকা দিতে হবে। পবিত্র এক পয়সাও দেবে না। এই ঘটনা পুরপ্রধান পর্যন্ত পৌঁছালো।

- পুরো প্রধান বললেন, পবিত্রবাবু সারা জীবন একটা নারীকে ভোগ করেছেন বিয়ে ছাড়াই। যদি ওর দাবি না মানেন তাহলে পুলিশের কাছে কেসটা পাঠাতে হবে। ব্যাপারটা পুলিশ দেখুক। পুলিশের  ভয়ে পাঁচ লাখ টাকায় রফা হলো। মৌলি টাকা নিয়ে পবিত্রকে ত্যাগ করে চলে যায়।

বেশ কয়েক মাস পর ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক এলো পবিত্র কাছে। পবিত্র এক দেখাতেই চিনতে পারলেন তার ছেলে বিক্রম। ডাক নাম রাজু। - বাবার বৃদ্ধ বয়সে এহেন অবস্থা দেখে খুব দুঃখ প্রকাশ করল তারপর একটা ফ্রিজ কিনে এনে সাতদিনের রান্না করে ফ্রিজে রেখে বলল, বাবা তুমি গরম করে করে খাবে যদি দরকার বোঝো তাহলে একটু আধটু রান্না করবে।

- পবিত্রর মতো কৃপণ রান্না করবে! বললেন, বয়স হয়েছে বাবা কতটুকু খাই। ওই খাবারেই বেড়ে যাবে।

- রাজু বললো, বেশ আমি প্রতি সপ্তাহে আসবো। আমি বাড়ি গিয়ে মাকে বোঝাই মা সম্মতি জানালে তোমাকে নিয়ে যাবো।

- তোর মা কি রাজি হবে?

- হবে না। তবে রাজি করাতে হবে তার জন্য সময় চাই। এখন ইচ্ছে থাকলেও নিয়েও যাওয়া যাবে না, কারণ আমরা মামার বাড়িতে থাকি। আমি এখন ভালো মাইনের চাকরি করছি। ফ্ল্যাট একটা বারোশো স্কয়ার ফিটের বুক করেছি। ফ্ল্যাটটি হ্যান্ডওভার পেলেই তোমাকে নিয়ে যাবো। 

প্রতি সপ্তাহে রাজু আসে। এই রকম ভাবে মাস ছয় চললো।

প্রতি সপ্তাহে পবিত্র জিজ্ঞাসা করেন, তোর মা সম্মতি দিয়েছে? ফ্ল্যাটের কতদূর? সদ উত্তর পায় না ।

একদিন রাজুকে চেপে ধরলো।

- রাজু বললো,  মা কোনরকম সম্মতি জানিয়েছে।

- তাহলে আমাকে নিয়ে চল।

- এখনো ফ্ল্যাটটি হ্যান্ডওভার পায়নি।

- সে কি! কেন? ছয় মাস হয়ে গেল, পাসনি কেন?

- পেয়ে যাবো, পেয়ে যাব। তুমি চিন্তা করো না বাবা,চিন্তা করো না ।

- বললেই হলো চিন্তা করো না। ফ্লাট পেতে এতো

 বাধা কোথায়? খুলে বল। 

- রাজু বললো,  ফ্ল্যাটের দাম পয়ষট্টি লাখ। ব্যাংক থেকে লোন ও নিজের কাছে যা জমানো টাকা ছিল এই নিয়ে চল্লিশ লাখ দিতে পেরেছি। এখনো পঁচিশ লাখ বাকি তাই পাচ্ছিনা ফ্লাটটা।  তবে চিন্তা করো না বাবা আমি ঠিক যোগাড় করে নেবো। তারপর তোমাকে নিয়ে যাবো। কথা দিলাম।

- দেখ ছেলের কান্ড! তুই আমার একমাত্র সন্তান তুই ঋণে জর্জরিত সেটা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো! আমার কাছে টাকা থাকা সত্ত্বেও! আমি দেবো।

- না বাবা আমি নিতে পারবো না। টাকাই তোমার শেষ সম্বল।

-  কে বলল টাকাই আমার শেষ সম্বল? তুই আমার শেষ সম্বল।

- সে তো বটেই, তবু আমি নিতে পারবো না।

- এবার আমি শাসন করবো। তোকে নিতেই হবে।

পঁচিশ লাখ টাকা রাজু খুব মনমরা হয়ে নিজের একাউন্টে ট্রান্সফার করে নিলো। বললো, সামনের সপ্তাহে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।

     তার পরের সপ্তাহে এসে এক সপ্তাহ থেকে যা যা কাজ করার করল। যে ডি.পি.এলের কোয়ার্টার সে থাকত তার কাগজপত্র জমা অফিশিয়ালি যা যা কাজ করে কোয়াটার্স বাবদ যে টাকা কেটে রেখেছিল ডিপিএল সেটাও কম নয় প্রায় বারো লাখ সেই সমস্ত পবিত্র একাউন্টে ট্রান্সফার করলো। তারপর সেভিংস, ফিক্স ডিপোজিট সব মিলিয়ে পঞ্চাশ লাখ টাকা ও কোয়াটার্স বাবদ 12 লাখ টাকা এই বাষট্টি লাখ টাকা সব ট্রান্সফার করল কলকাতায় ব্যাঙ্কে, কারণে এখানে ব্যাংকে থেকে কি লাভ।

     পবিত্র জানেনা যে যেকোন জায়গা থেকে নিজের টাকা তোলা যায়। আর ভাবলো এখানে যখন থাকবোই না তখন কি দরকার এখানে থাকার।

     যে দিনে যাবে সেই দিন রাজু বললো, বাবা একটু অফিসের কাজ আছে কাজ সেরে সাড়ে বারোটার  শতাব্দী এক্সপ্রেস ট্রেনে যাবো।

     রাজু সেই যে গেলো আর ফিরে এলোনা। সন্ধ্যায় ডি.পি.এলের  লোক এসে পবিত্রকে কোয়াটার্স থেকে বার করে তালা লাগিয়ে দিলো। তখন থেকে পবিত্র পথের ভিখারী।

     শ্মশানে যায় লিস্ট জোগাড় করে কে কে মারা গেছে তাদের শ্রাদ্ধ বাড়িতে যায়। যে যে মরেছে তাদের বয়স কতো সব কিছু জেনে নিয়ে সেই মতো সম্পর্ক বানিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে বিয়ে বাড়িতে হয় বরপক্ষ নয় কনেপক্ষ সেজে খাওয়া-দাওয়া করে। যখন এলাকার সবাই জেনে গেল তখন আর স্থান  নেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। তাই খাবারের সন্ধানে এতদূর এসেছে পবিত্রদা। অসীম বিশ্বাসের মেয়ের বিয়ে নিজের সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন। অচিন্ত্যবাবুকে একজন দরিদ্র অসহায় কে কোলে নিয়ে বসে আছে দেখে বললো, কি ব্যাপার অচিন্ত্য? 

- কি ব্যাপার? তুমি কি কিছুই শোননি? এই লোকটি ক্ষুধার্ত, খেতে চেয়েছিল। খেতে তো দেয়নি হিড় হিড় করে টেনে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। একটা ক্ষুধার্ত লোক খেলে আপনার মেয়ের ভোজের খাবারের অনটন হতো? বরং মেয়ের মঙ্গল হতো। তাও বলছি আমার তো নেমন্তন্ন আছে, আমরা বাড়িতে তিনজন, তিনবেলা নিমন্তন্ন তারমানে নটি প্লেট, আমরা আসবো না। আমরা আসবো সন্ধ্যায় তোমার মেয়েকে আশির্বাদ করে যাব কিন্তু খাবো না। সেই খাবার ইনাকে দেবে ।ভাই কেউ এর জন্য রুটি তরকারি এনে দাও আমি টাকা দিচ্ছি, তোমরা দেখো। অসীমদা আমাকে স্কুলে যেতেই হবে, তা না  হলে  সাথে নিয়ে যেতাম বা খাইয়ে যেতাম। 

- অসীমবাবু বললেন, ক্ষমা করো ভাই, ভুল হয়ে গেছে। কে করেছে আমি জানি না।তোমাকে টাকা দিয়ে খাবার কিনে খাওয়াতে হবে না ।আমিই ইনাকে খাওয়াবো। আর দয়া করে আমার বাড়ির অন্ন গ্রহণ করে মেয়েকে আশীর্বাদ  করবে কথা দাও।

- অচিন্ত্য সম্মতিসূচক ঘাড়ে নেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Accept !